পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\სტ88 রবীন্দ্র-রচনাবলী স্বভাবতই নানা বর্ণে নানা আকারে দিকে দিকে উশীলিত হইয়া উঠিত । এ যে সোনার কাঠি— ইহার স্পর্শকে উপেক্ষা করিয়া অসাড় হইয়া কে পড়িয়া থাকিতে পারে ! ইহাতে সামান্য লোককেও যে অসামান্য করিয়া তোলে। সেই প্রবল অসামান্যতার স্বাদ মানুষ জীবনে যদি একবারও পায় তবে জীবনের সত্য পরিচয় সে লাভ করে। বিনয় কহিল, “গোরা, আমি তোমাকে নিশ্চয় বলিতেছি মানুষের সমস্ত প্রকৃতিকে এক মুহুর্তে জাগ্ৰত করিবার উপায় এই প্রেম- যে কারণেই হউক, আমাদের মধ্যে এই প্রেমের আবির্ভাব দুর্বল— সেইজন্যই আমরা প্রত্যেকেই আমাদের সম্পূর্ণ উপলব্ধি হইতে বঞ্চিত— আমাদের কী আছে তাহা আমরা জানি না, যাহা গোপন আছে তাহাকে প্রকাশ করিতে পারিতেছি না, যাহা সঞ্চিত আছে তাহাকে ব্যয় করা আমাদের অসাধ্য। সেইজন্যই চারি দিকে এমন নিরানন্দ, এমন নিরানন্দ ! সেইজন্যই আমাদের নিজের মধ্যে যে কোনো মাহাত্ম্য আছে তাহা কেবল তোমাদের মতো দুই-এক জনেই বোঝে, সাধারণের চিত্তে তাহার কোনো চেতনা নাই ।” Aa মহিম সশব্দে হাই তুলিয়া বিছানা হইতে উঠিয়া যখন মুখ ধুইতে গেলেন তাহার পদশব্দে বিনয়ের উৎসাহ প্ৰবাহ বন্ধ হইয়া গেল, সে গোরার কাছে বিদায় লইয়া চলিয়া গেল । গোরা ছাতের উপর দাড়াইয়া পূর্ব দিকের রক্তিম আকাশে চাহিয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল । অনেকক্ষণ ধরিয়া ছাতে বেড়াইল, আজ তাহার। আর গ্রামে যাওয়া হইল না । আজকাল গোরা নিজের হৃদয়ের মধ্যে যে-একটি আকাঙক্ষা, যে-একটি পূর্ণতার অভাব অনুভব করিতেছে, কোনোমতেই কোনো কাজ দিয়াই তাহা সে পূরণ করিতে পারিতেছে না। শুধু সে নিজে নহে, তাহার সমস্ত কাজও যেন উর্ধের্বর দিকে হাত বাড়াইয়া বলিতেছে- একটা আলো চাই, উজ্জ্বল আলো, সুন্দর আলো ! যেন আর-সমস্ত উপকরণ প্রস্তুত আছে, যেন হীরামানিক সোনারুপা দুর্মুল্য নয়, যেন লীেহ বাজ বর্ম চর্ম দুর্লভ নয়- কেবল আশা ও সান্তনায় উদভাসিত স্নিগ্ধসুন্দর অরুণরাগমণ্ডিত আলো কোথায় ? যাহা আছে তাহাকে আরো বাড়াইয়া তুলিবার জন্য কোনো প্ৰয়াসের প্রয়োজন নাই, কিন্তু তাহাকে সমুজ্জ্বল করিয়া, লাবণ্যময় করিয়া, প্রকাশিত করিয়া তুলিবার যে অপেক্ষা আছে। বিনয় যখন বলিল, “কোনো কোনো মহেন্দ্রক্ষণে নরনারীর প্রেমকে আশ্রয় করিয়া একটি অনির্বচনীয় অসামান্যতা উদভাসিত হইয়া উঠে তখন গোরা পূর্বের ন্যায় সে কথাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারিল না। গোরা মনে মনে স্বীকার করিল তাহা সামান্য মিলন নহে, তাহা পরিপূর্ণতা, তাহার সংস্রবে। সকল জিনিসেরই মূল্য বাড়িয়া যায় ; তাহা কল্পনাকে দেহ দান করে, ও দেহকে প্ৰাণে পূর্ণ করিয়া তোলে ; তাহা প্ৰাণের মধ্যে প্ৰাণন ও মনের মধ্যে মননকে কেবল যে দ্বিগুণিত করে তাহা নহে, তাহাকে একটি নূতন রসে অভিষিক্ত করিয়া দেয়। বিনয়ের সঙ্গে আজ সামাজিক বিচ্ছেদের দিনে বিনয়ের হৃদয় গোরার হৃদয়ের ‘পরে একটি অখণ্ড একতান সংগীত বাজাইয়া দিয়া গেল। বিনয় চলিয়া গেল, বেলা বাড়িতে লাগিল, কিন্তু সে সংগীত কোনোমতেই থামিতে চাহিল না। সমুদ্ৰগামিনী দুই নদী একসঙ্গে মিলিলে যেমন হয়, তেমনি বিনয়ের প্রেমের ধারা আজ গোরার প্রেমের উপরে আসিয়া পড়িয়া তরঙ্গের দ্বারা তরঙ্গকে মুখরিত করিতে লাগিল। গোরা যাহাকে কোনোপ্রকারে বাধা দিয়া, আড়াল দিয়া, ক্ষীণ করিয়া নিজের অগোচরে রাখিবার চেষ্টা করিতেছিল, তাহাই আজ কুল ছাপাইয়া আপনাকে সুস্পষ্ট ও প্রবল মূর্তিতে ব্যক্ত করিয়া দিল। তাহাকে অবৈধ বলিয়া নিন্দা করিবে, তাহাকে তুচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিবে, এমন শক্তি আজ গোরার রহিল না । সমস্ত দিন এমন করিয়া কাটিল ; অবশেষে অপরাতু যখন সায়াহ্নে বিলীন হইতে চলিয়াছে তখন গোরা একখানা চাদর পাডিয়া লইয়া কঁধের উপর ফেলিয়া পথের মধ্যে বাহির হইয়া পড়িল । গোরা কহিল, "যে আমারই তাহাকে আমি লইব । নইলে পৃথিবীতে আমি অসম্পূর্ণ, আমি ব্যর্থ হইয়া যাইব ।” সমস্ত পৃথিবীর মাঝখানে সুচরিতা তাঁহারই আহবানের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে, ইহাতে গোরার