পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(list \ტ8(? মনে লেশমাত্র সংশয় রহিল না। আজই, এই সন্ধাতেই, এই অপেক্ষাকে সে পূর্ণকরবে। জনাকীর্ণ কলিকাতার রাস্তা দিয়া গোরা বেগে চলিয়া গেল। কেহই যেন, কিছুতেই যেন, তাহাকে স্পর্শ করিল না। তাহার মন তাহার শরীরকে অতিক্রম করিয়া একাগ্ৰ হইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। সুচরিতার বাড়ির সম্মুখে আসিয়া গোরা যেন হঠাৎ সচেতন হইয়া থামিয়া দাড়াইল। এতদিন আসিয়াছে কখনো দ্বার বন্ধ দেখে নাই, আজ দেখিল দরজা খোলা নহে। ঠেলিয়া দেখিল, ভিতর ঠুক। ধাইয় প্রশ্ন ক্সি লি, অন্তর পরে দ্বারে আঘাত করিয়া দুই-চারি বার শব্দ বেহার দ্বার খুলিয়া বাহির হইয়া আসিল। সে সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোকে গােরাকে দেখিতেই কোনাে প্রশ্নের অপেক্ষা না করিয়াই কহিল, দিদিঠাকরুন বাড়িতে নাই। QPQ: 2 তিনি ললিতাদিদির বিবাহের আয়োজনে কয় দিন হইতে অন্যত্র ব্যাপৃত রহিয়াছেন। ক্ষণকালের জন্য গোরা মনে করিল সে বিনয়ের বিবাহসভাতেই যাইবে । এমন সময় বাড়ির ভিতর হইতে একটি অপরিচিত বাবু বাহির হইয়া কহিল, “কী মহাশয়, কী চান ?” গোরা তাহাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, “না, কিছু চাই নে ৷” কৈলাস কহিল, “আসুন-না একটু বসবেন, একটু তামাক ইচ্ছা করুন।” সঙ্গী অভাবে কৈলাসের প্রাণ বাহির হইয়া যাইতেছে। যে হােক একজন কাহাকেও ঘরের মধ্যে টানিয়া লইয়া গল্প জমাইতে পারিলে সে বঁাচে । দিনের বেলায় হঁক হাতে গলির মোড়ের কাছে দাড়াইয়া রাস্তায় লোকচলাচল দেখিয়া তাহার সময় একরকম কাটিয়া যায়, কিন্তু সন্ধ্যার সময় ঘরের মধ্যে তাহার প্রাণ হাঁপাইয়া উঠে । হরিমোহিনীর সঙ্গে তাহার যাহা-কিছু আলোচনা করিবার ছিল তাহা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হইয়া গেছে। হরিমোহিনীর আলাপ করিবার শক্তিও অত্যন্ত সংকীর্ণ। এইজন্য কৈলাস নীচের তলায় বাহির-দরজার পাশে একটি ছোটাে ঘরে তক্তপোশে ইকা লইয়া বসিয়া মাঝে মাঝে বেহারাটাকে ডাকিয় তাহার সঙ্গে গল্প করিয়া সময় যাপন করিতেছে। গোরা কহিল, “না, আমি এখন বসতে পারছি নে ৷” কৈলাসের পুনশ্চ অনুরোধের সূত্রপাতেই চােখের পলক না ফেলিতেই সে একেবারে গলি পার হইয়া গেল । গোরার একটি সংস্কার তাহার মনের মধ্যে দৃঢ় হইয়া ছিল যে, তাহার জীবনের অধিকাংশ ঘটনাই আকস্মিক নহে, অথবা কেবলমাত্র তাহার নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছার দ্বারা সাধিত হয় না । সে তাহার স্বদেশবিধাতার একটি কোনো অভিপ্ৰায় সিদ্ধ করিবার জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়াছে। এইজন্য গোরা নিজের জীবনের ছােটাে ছােটাে ঘটনারও একটা বিশেষ অর্থ বুঝিতে চেষ্টা করিত। আজ যখন সে আপনার মনের এতবড়ো একটা প্রবল আকাঙক্ষাবেগের মুখে হঠাৎ আসিয়া সুচরিতার দরজা বন্ধ দেখিল এবং দরজা খুলিয়া যখন শুনিল সুচরিতা নাই, তখন সেইহাকে একটি অভিপ্রায়পূর্ণ ঘটনা বলিয়াই গ্রহণ করিল। তাহাকে যিনি চালনা করিতেছেন তিনি গোরাকে আজ এমনি করিয়া নিষেধ জানাইলেন। এ জীবনে সুচরিতার দ্বার তাহার পক্ষে রুদ্ধ, সুচরিতা তাহার পক্ষে নাই। গোরার মতো মানুষকে নিজের ইচ্ছা লইয়া মুগ্ধ হইলে চলিবে না, তাহার নিজের সুখদুঃখ নাই। সে ভারতবর্ষের ব্ৰাহ্মণ, ভারতবর্ষের হইয়া দেবতার আরাধনা তাহাকে করিতে হইবে, ভারতবর্ষের হইয়া তপস্যা তাঁহারই কাজ। আসক্তি-অনুরক্তি তাহার নহে। গোরা মনে মনে কহিল, “বিধতা আসক্তির রূপটা আমার কাছে স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়া দিলেন- দেখাইলেন তাহা শুভ্ৰ নহে, শান্ত নহে, তাহা মদের মতো রক্তবর্ণ ও মদের মতো তীব্র ; তাহা বুদ্ধিকে স্থির থাকিতে দেয় না, তাহা এককে আর করিয়া দেখায় ; আমি সন্ন্যাসী, আমার সাধনার মধ্যে তাহার স্থান নাই।”