পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা \ხ8 Či সুচরিতাকে ফাঁদে ফেলিবার জন্য মা কৌশলজাল বিস্তার করিতেছে। তিনি স্পষ্টই দেখিতে পাইলেন ইহাতে মাতাপুত্রের পরামর্শ আছে। আনন্দময়ীর ভাবগতিক দেখিয়া গোড়াতেই যে র্তাহার ভালো লাগে নাই সে কথাও তিনি স্মরণ করিলেন । আর কিছুমাত্র বিলম্ব না করিয়া যত শীঘ্ৰ সম্ভব সুচরিতাকে একবার বিখ্যাত রায়গোষ্ঠীর অন্তৰ্গত । করিয়া নিরাপদ করিয়া তুলিতে পারিলে তিনি বাচেন ।। কৈলাসকেই বা এমন করিয়া কতদিন বসাইয়া রাখা যায় ! সে বেচারা যে অহােরাত্ৰ তামাক টানিয়া টানিয়া বাড়ির দেয়ালগুলা কালি করিবার জো করিল। . লইয়া স্বয়ং বিনয়ের বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন নীচের ঘরে সুচরিতা ললিতা ও আনন্দময়ী রান্নাবান্নার আয়োজনে বসিয়া গেছেন । উপরের ঘরে বানান-সমেত ইংরাজি শব্দ ও তাহার বাংলা প্রতিশব্দ মুখস্থ করার উপলক্ষে সতীশের কণ্ঠস্বরে সমস্ত পাড়া সচকিত হইয়া উঠিয়াছে। বাড়িতে তাহার গলার এত জোর অনুভব করা যাইত না, কিন্তু এখানে সে যে তাহার পড়াশুনায় কিছুমাত্র অবহেলা করিতেছে না। ইহাই নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিবার জন্য তাঁহাকে অনেকটা উদ্যম তাহার কণ্ঠস্বরে অনাবশ্যক প্রয়োগ করিতে হইতেছে। হরিমোহিনীকে আনন্দময়ী বিশেষ সমাদরের সহিত অভ্যর্থনা করিলেন । সে-সমস্ত শিষ্টাচারের প্ৰতি মনোযোগ না করিয়া তিনি একেবারেই কহিলেন, “আমি রাধারানীকে নিতে এসেছি।” আনন্দময়ী কহিলেন, “তা, বেশ তো, নিয়ে যাবে, একটু বোসো ।” হরিমোহিনী কহিলেন, “না, আমার পূজা-আৰ্চা সমস্তই পড়ে রয়েছে, আমার আহ্নিক সারা হয় নি- আমি এখন এখানে বসতে পারব না ।” সুচরিতা কোনো কথা না কহিয়া অলাবুচ্ছেদনে নিযুক্ত ছিল । হরিমোহিনী তাহাকেই সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “শুনছ। বেলা হয়ে গেল।” ললিতা এবং আনন্দময়ী নীরবে বসিয়া রহিল । সুচরিতা তাহার কাজ রাখিয়া উঠিয়া পড়িল এবং কহিল, “মাসি, এসো ।” “এসো, একবার এ ঘরে এসো ।” ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া সুচরিতা দৃঢ়স্বরে কহিল, “তুমি যখন আমাকে নিতে এসেছ তখন সকল লোকের সামনেই তোমাকে আমনি ফিরিয়ে দেব না, আমি তোমার সঙ্গেই যাচ্ছি, কিন্তু আজ দুপুরবেলাই আমি এখানে আবার ফিরে আসব।” হরিমোহিনী বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “এ আবার কেমন কথা । তা হলে বলো-না কেন, এইখানেই চিরকাল থাকবে ।” সুচরিতা কহিল, “চিরকাল তো থাকতে পাব না। সেইজন্যই যতদিন ওঁর কাছে থাকতে পাই, আমি ওঁকে ছাড়ব না।” এই গ্রী হরমোিহনীর গবলিয়া গেল, কিন্তু এখন কােনাে কথা বল তিনি মুক্তি বলিয়া বােধ (ळ | সুচরিতা আনন্দময়ীর কাছে আসিয়া হাস্যমুখে কহিল, “মা, আমি তবে একবার বাড়ি হয়ে আসি।” আনন্দময়ী কোনো প্রশ্ন না করিয়া কহিলেন, “তা, এসো মা !” সুচরিতা ললিতার কানে কানে কহিল, “আজ আবার দুপুরবেলা আমি আসব।” হরিমোহিনী কহিলেন, “সতীশ থাক-না।” সতীশ বাড়ি গেলে বিঘ্নস্বরূপ হইয়া উঠিতে পারে এই মনে করিয়া সতীশের দূরে অবস্থানই তিনি সুযোগ বলিয়া গণ্য করিলেন।