পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(53 \ხ8პ সুচরিতা কহিল, “না।” সে না” এতই প্রবল এবং স্পষ্ট যে হরিমোহিনীকে একটু হঠিতে হইল। তিনি কহিলেন, “আচ্ছা! বেশ, তা নাই হল। দেখার তো কোনো দরকার নেই, তবে কৈলাস আজকালকার ছেলে, লেখাপড়া শিখেছে, তোমাদেরই মতো ও তো কিছুই মানে না, বলে “পাত্রী নিজের চক্ষে দেখব । তা তোমরা সবার সামনেই বেরোও তাই বললুম, “দেখবে সে আর বেশি কথা কী, একদিন দেখা করিয়ে দেব” । তা, তোমার লজা হয় তো দেখা নাই হল ।” এই বলিয়া কৈলাস যে কিরূপ আশ্চর্য লেখাপড়া করিয়াছে, সে যে তাহার কলমের এক আঁচড়-মাত্রে তাহার গ্রামের পোস্টমাস্টারকে কিরূপ বিপন্ন করিয়াছিল— নিকটবতী চারি দিকের গ্রামের যে-কাহারোই মামলা-মকদ্দমা করিতে হয়, দরখাস্ত লিখিতে হয়, কৈলাসের পরামর্শ ব্যতীত যে কাহারও এক পা চলিবার জো নাই— ইহা তিনি বিবৃত করিয়া বলিলেন । আর, উহার স্বভাবচরিত্রের কথা বেশি করিয়া বলাই বাহুল্য। ওর স্ত্রী মরার পর ও তো কিছুতেই বিবাহ করিতে চায় নাই ; আত্মীয়স্বজন সকলে মিলিয়া অত্যন্ত বলপ্রয়োগ করাতে ও কেবল গুরুজনের আদেশ পালন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। উপস্থিত প্রস্তাবে সম্মত করিতে হরিমোহিনীকেই কি কম কষ্ট পাইতে হইয়াছে ! ও কি কৰ্ণপাত করিতে চায় ! ওরা যে মস্ত বংশ । সমাজে ওদের যে ভারি মান । সুচরিতা এই মান খর্ব করিতে কিছুতেই স্বীকার করিল না। কোনোমতেই না। সে নিজের গৌরব ও স্বার্থের প্রতি দৃকপাত মাত্র করিল না। এমন-কি, হিন্দুসমাজে তাহার স্থান যদি নাও হয় তথাপি সে লেশমাত্র বিচলিত হইবে না, এইরূপ তাহার ভাব দেখা গেল। কৈলাসকে বহু চেষ্টায় বিবাহে রাজি করানোতে সুচরিতার পক্ষে অল্প সম্মানের কারণ হয় নাই। এ কথা সে মূঢ় কিছুতেই উপলব্ধি করিতে পারিল না, উলটিয়া সে ইহাকে অপমানের কারণ বলিয়া গণ্য করিয়া বসিল। আধুনিক কালের এই সমস্ত বিপরীত ব্যাপারে হরিমোহিনী সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন। তখন তিনি মনের আক্ৰোশে বার বার গোরার প্রতি ইঙ্গিত করিয়া খোচা দিতে লাগিলেন । গোরা যতই নিজেকে হিন্দু বলিয়া বড়াই করুক-না কেন, সমাজের মধ্যে উহার স্থান কী ! উহাকে কে মানে ! ও যদি লোভে পড়িয়া ব্ৰাহ্মঘরের কোনো টাকাওয়ালা মেয়েকে বিবাহ করে তবে সমাজের শাসন হইতে ও পরিত্ৰাণ লাভ করিবে কিসের জোরে !! তখন দশের মুখ বন্ধ করিয়া দিবার জন্য টাকা যে সমস্ত ফুকিয়া দিতে হইবে। ইত্যাদি । সুচরিতা কহিল, “মাসি, এ-সব কথা তুমি কেন বলছ ? তুমি জান এসব কথারকোনো মূল নেই।” হরিমোহিনী তখন বলিলেন, তাহার যে বয়স হইয়াছে সে বয়সে কথা দিয়া তঁহাকে ভোলানো কাহারও পক্ষে সাধ্য নহে। তিনি চোখ-কান খুলিয়াই আছেন ; দেখেন শোনেন বুঝেন সমস্তই, কেবল নিঃশব্দে অবাক হইয়া রহিয়াছেন। গোরা যে তাহার মাতার সঙ্গে পরামর্শ করিয়া সুচরিতাকে বিবাহ করিবার চেষ্টা করিতেছে, সে বিবাহের গৃঢ় উদ্দেশ্যও যে মহৎ নহে, এবং রায়গোষ্ঠীর সহযোগে যদি তিনি সুচরিতাকে রক্ষা করিতে না পারেন তবে কালে যে তাঁহাই ঘটিবে, সে সম্বন্ধে তিনি তাহার নিঃসংশয় বিশ্বাস প্রকাশ করিলেন । , সহিষ্ণুস্বভাব সুচরিতার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিল; সে কহিল, “তুমি যাদের কথা বলছি আমি র্তাদের ভক্তি করি, তাদের সঙ্গে আমার যে সম্বন্ধ সে যখন তুমি কোনোমতেই ঠিকভাবে বুঝবে না তখন আমার আর কোনো উপায় নেই, আমি এখনই এখান থেকে চললুম— যখন তুমি শান্ত হবে এবং বাড়িতে তোমার সঙ্গে একলা এসে বাস করতে পারব তখন আমি ফিরে আসব।” হরিমোহিনী কহিলেন, “গৌরমোহনের প্রতিই যদি তোর মন নেই, যদি তার সঙ্গে তোর বিয়ে হবেই না এমন কথা থাকে, তবে এই পত্রটি দোষ করেছে কী ? তুমি তো আইবুড়ো থাকবে না ?” সুচরিতা কহিল, “কেন থাকব না ! আমি বিবাহ করব না।” হরিমোহিনী চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন, “বুড়োবয়স পর্যন্ত এমনি—”