পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\Vt (? O রবীন্দ্র-রচনাবলী Գ Տ এই আঘাতে গোরার মনে একটা পরিবর্তন আসিল । সুচরিতার দ্বারা গোরার মন যে আক্রান্ত হইয়াছে তাহার কারণ সে ভাবিয়া দেখিল— সেইহাদের সঙ্গে মিশিয়াছে, কখন নিজের অগোচরে সে ইহাদের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করিয়া ফেলিয়াছে। যেখানে নিষেধের সীমা টানা ছিল সেই সীমা গোৱা দম্ভভরে লঙঘন করিয়াছে। ইহা আমাদের দেশের পদ্ধতি নহে। প্রত্যেকে নিজের সীমা রক্ষা করিতে না পারিলে সে যে কেবল জানিয়া এবং না জানিয়া নিজেরই অনিষ্ট করিয়া ফেলে তাহা নহে, অন্যেরও হিত করিবার বিশুদ্ধ শক্তি তাহার চলিয়া যায়। সংসর্গের দ্বারা নানাপ্রকার হৃদয়বৃত্তি প্রবল হইয়া, উঠিয়া জ্ঞানকে নিষ্ঠাকে শক্তিকে আবিল করিয়া তুলিতে থাকে। কেবল ব্ৰাহ্মঘরের মেয়েদের সঙ্গে মিশিতে গিয়াই সে এই সত্য আবিষ্কার করিয়াছে তাহা নহে । গোরা জনসাধারণের সঙ্গে যে মিলিতে গিয়াছিল। সেখানেও একটা যেন আবর্তের মধ্যে পড়িয়া নিজেকে নিজে হারাইবার উপক্ৰম করিয়াছিল । কেননা, তাহার পদে পদে দয়া জন্মিতেছিল ; এই দয়ার বশে সে কেবলই ভাবিতেছিল এটা মন্দ, এটা অন্যায়, এটাকে দূর করিয়া দেওয়া উচিত। কিন্তু এই দয়াবৃত্তিই কি ভালো-মন্দ-সুবিচারের ক্ষমতাকে বিকৃত করিয়া দেয় না ? দয়া করিবার ঝোকটা আমাদের যতই বাড়িয়া উঠে নির্বিকারভাবে সত্যকে দেখিবার শক্তি আমাদের ততই চলিয়া যায়— প্রধূমিত করুণার কালিমা মাখাইয়া যাহা নিতান্ত ফিক তাহাকে অত্যন্ত গাঢ় করিয়া দেখি । গোরা কহিল— এইজনাই যাহার প্রতি সমগ্রের হিতের ভার তাহার নির্লিপ্ত থাকিবার বিধি আমাদের দেশে চলিয়া আসিয়াছে। প্রজার সঙ্গে একেবারে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিলে তবেই যে প্ৰজাপালন করা রাজার পক্ষে সম্ভব হয় এ কথা সম্পূর্ণ অমূলক। প্রজাদের সম্বন্ধে রাজার যেরূপ জ্ঞানের প্রয়োজন সংস্রবের দ্বারা তাহা কলুষিত হয়। এই কারণে, প্রজারা নিজেই ইচ্ছা করিয়া তাহাদের রাজাকে দূরত্বের দ্বারা বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে। রাজা তাঁহাদের সহচর হইলেই রাজার প্রয়োজন চলিয়া যাইবে । ব্ৰাহ্মণও সেইরূপ সুদূরস্থ, সেইরূপ নির্লিপ্ত | ব্ৰাহ্মণকে অনেকের মঙ্গল করিতে হইবে, এইজনাই অনেকের সংসৰ্গ হইতে ব্ৰাহ্মণ বঞ্চিত | গোরা কহিল, ‘আমি ভারতবর্ষের সেই ব্ৰাহ্মণ ' দশজনের সঙ্গে জড়িত হইয়া, ব্যবসায়ের পঙ্কে লুষ্ঠিত হইয়া, অর্থের প্রলোভনে লুব্ধ হইয়া, যে ব্ৰাহ্মণ শূদ্ৰত্বের ফাস গলায় বাধিয়া উদবন্ধনে মরিতেছে গোরা তাহাদিগকে তাহার স্বদেশের সজীব পদার্থের মধ্যে গণ্য করিল না ; তাহাদিগকে শূদ্রের অধম করিয়া দেখিল, কারণ, শূদ্র আপনি শূদ্ৰত্বের দ্বারাই বীচিয়া আছে, কিন্তু ইহারা ব্ৰাহ্মণত্বের অভাবে মৃত, সুতরাং ইহারা অপবিত্র । ভারতবর্ষ ইহাদের জন্য আজ এমন দীনভাবে অশৌচ যাপন করিতেছে। গোরা নিজের মধ্যে সেই ব্ৰাহ্মণের সঞ্জীবন-মন্ত্র সাধনা করিবে বলিয়া মনকে আজ প্রস্তুত করিল। কহিল, “আমাকে নিরতিশয় শুচি হইতে হইবে। আমি সকলের সঙ্গে সমান ভূমিতে দাড়াইয়া নাই। বন্ধুত্ব আমার পক্ষে প্রয়োজনীয় সামগ্ৰী নহে, নারীর সঙ্গ যাহাদের পক্ষে একান্ত উপাদেয়। আমি সেই সামান্যশ্রেণীর মানুষ নই, এবং দেশের ইতরসাধারণের ঘনিষ্ঠ সহবাস আমার পক্ষে সম্পূর্ণ বৰ্জনীয়। পৃথিবী সুদূর আকাশের দিকে বৃষ্টির জন্য যেমন তাকাইয়া আছে ব্ৰাহ্মণের দিকে ইহারা তেমনি করিয়া তাকাইয়া আছে, আমি কাছে আসিয়া পড়িলে ইহাদিগকে বঁাচাইবে কে ? ? ইতিপূর্বে দেবপূজায় গোরা কোনােদিন মন দেয় নাই। যখন হইতে তাহার হৃদয় ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে, কিছুতেই সে আপনাকে বাধিয়া রাখিতে পারিতেছে না, কাজ তাহার কাছে শূন্য বােধ হইতেছে এবং জীবনটা যেন আধখানা হইয়া কঁাদিয়া মরিতেছে, তখন হইতে গোরা পূজায় মন দিতে চেষ্টা করিতেছে। প্রতিমার সম্মুখে স্থির হইয়া বসিয়া সেই মূর্তির মধ্যে গোরা নিজের মনকে একেবারে নিবিষ্ট করিয়া দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো উপায়েই সে আপনার ভক্তিকে জাগ্ৰত করিয়া তুলিতে পারে না। দেবতাকে সে বুদ্ধির দ্বারা ব্যাখ্যা করে, তাহাকে রূপক করিয়া না তুলিয়া কোনোমতেই গ্ৰহণ