পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VG NR রবীন্দ্র-রচনাবলী নাই। গোরা তাহাকে গালি দিলেও সে গায়ে লয় না, বরঞ্চ খুশি হয়। ‘আমার গুরু অত্যুচ্চ ভাবলোকেই বিহার করেন, এ-সমস্ত পৃথিবীর কথা কিছুই বােঝেন না। তিনি বৈকুণ্ঠবাসী নারদের মতো বীণা বাজাইয়া বিষ্ণুকে বিগলিত করিয়া গঙ্গার সৃষ্টি করিতেছেন, কিন্তু সেই গঙ্গাকে মর্তে প্রবাহিত করিয়া সগরসন্তানের ভস্মরাশি সঞ্জীবিত করিবার কাজ পৃথিবীর ভগীরথের— সে স্বর্গের লোকের কর্ম নয়। এই দুই কাজ একেবারে স্বতন্ত্র। অতএব অবিনাশের উৎপাতে গোরা যখন আগুন হইয়া উঠে তখন অবিনাশ মনে মনে হাসে, গোরার প্রতি তাহার ভক্তি বাড়িয়া উঠে । সে মনে মনে বলে, “আমাদের গুরুর চেহারাও যেমন শিবের মতো তেমনি ভাবেও তিনি ঠিক ভোলানাথ। কিছুই বোঝেন না, কাণ্ডজ্ঞানমােত্রই নাই, কথায় কথায় রাগিয়া আগুন হন, আবার রাগ জুড়াইতেও বেশিক্ষণ লাগে की ।" অবিনাশের চেষ্টায় গোরার প্রায়শ্চিত্তের কথাটা লইয়া চারি দিকে ভারি একটা আন্দোলন উঠিয়া পড়ল। গােরাকে তাহার বাড়িতে আসিয়া দেখিবার জন্য, তাহার সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য, লােকের জনতা আরো বাড়িয়া উঠিল । প্রত্যহ চারি দিক হইতে তাহার এত চিঠি আসিতে লাগিল যে, চিঠি পড়া সে বন্ধ করিয়াই দিল । গোরার মনে হইতে লাগিল। এই দেশব্যাপ্ত আলোচনার দ্বারা তাহার প্ৰায়শ্চিত্তের সাত্ত্বিকতা যেন ক্ষয় হইয়া গেল, ইহা একটা রাজসিক ব্যাপার হইয়া উঠিল । ইহা কালেরই (oro | কৃষ্ণদয়াল আজকাল খবরের কাগজ স্পর্শও করেন না, কিন্তু জনশ্রুতি র্তাহার সাধনাশ্রমের মধ্যেও গিয়া প্রবেশ করিল। তাহার উপযুক্ত পুত্ৰ গোরা মহাসমারোহে প্ৰায়শ্চিত্ত করিতে বসিয়াছে এবং সে যে তাহার পিতারই পবিত্র পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াই এক কালে তাহার মতোই সিদ্ধপুরুষ হইয়া দাড়াইবে, এই সংবাদ ও এই আশা কৃষ্ণদয়ালের প্রসাদজীবীরা তাহার কাছে বিশেষ গৌরবের সহিত ব্যক্ত করিল | গোরার ঘরে কৃষ্ণদয়াল কতদিন যে পদার্পণ করেন নাই তাহার ঠিক নাই। তাহার পট্টবস্ত্ৰ ছাড়িয়া সুতার কাপড় পরিয়া আজ একেবারে তাহার ঘরে গিয়া প্রবেশ করিলেন। সেখানে গোরাকে দেখিতে পাইলেন না । চাকরকে জিজ্ঞাসা করিলেন। চাকর জানাইল, গোরা ঠাকুরঘরে আছে। আঁ্যা ! ঠাকুরঘরে তাহার কী প্রয়োজন ? তিনি পূজা করেন। কৃষ্ণদয়াল শশব্যস্ত হইয়া ঠাকুরঘরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, সত্যই গোরা পূজায় বসিয়া গেছে। কৃষ্ণদয়াল বাহির হইতে ডাকিলেন, “গােরা ।” গোরা তাহার পিতার আগমনে আশ্চর্য হইয়া উঠিয়া দাড়াইল । কৃষ্ণদয়াল তাহার সাধনাশ্রমে বিশেষভাবে নিজের ইষ্টদেবতার প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন । ইহাদের পরিবার বৈষ্ণব, কিন্তু তিনি শক্তিমন্ত্র লইয়াছেন, গৃহদেবতার সঙ্গে তাহার প্রত্যক্ষ যোগ অনেক দিন হইতেই নাই। তিনি গোরাকে কহিলেন, “এসো, এসো, বাইরে এসো ।” গোরা বাহির হইয়া আসিল । কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “এ কী কাণ্ড ! এখানে তোমার কী কাজ ।” গোরা কোনো উত্তর করিল না। কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “পূজারি ব্ৰাহ্মণ আছে, সে তো প্রত্যহ পূজা করে— তাতেই বাড়ির সকলেরই পূজা হচ্ছে, তুমি কেন এর মধ্যে এসেছ!” গোরা কহিল, “তাতে কোনো দোষ নেই।” কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “দোষ নেই! বল কী ! বিলক্ষণ দোষ আছে! যারা যাতে অধিকার নেই তার সে কাজে যাবার দরকার কী ! ওতে যে অপরাধ হচ্ছে। শুধু তোমার নয়, বাড়িসুদ্ধ আমাদের সকলের ।” গোরা কহিল, “যদি অন্তরের ভক্তির দিক দিয়ে দেখেন তা হলে দেবতার সামনে বসবার অধিকার অতি অল্প লোকেরই আছে, কিন্তু আপনি কি বলেন আমাদের ঐ রামহরি ঠাকুরের এখানে পূজা করবার