পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V)(?br রবীন্দ্র-রচনাবলী “বিবাহই নারীর জীবনে সাধনার পথ,গৃহধৰ্মই তাহার প্রধান ধর্ম। এই বিবাহ ইচ্ছাপূরণের জন্য নহে, কল্যাণসাধনের জন্য। সংসার সুখেরই হউক আর দুঃখেরই হউক, একমনে সেই সংসারকেই বরণ করিয়া, সতী সাধবী পবিত্র হইয়া, ধর্মকেই রমণী গৃহের মধ্যে মূর্তিমান করিয়া রাখবেন এই তাহাদের ব্ৰত | হরিমোহিনী কহিলেন, “অমনি আমাদের কৈলাসের কথাটা একটুখানি লিখে দিলে ভালো করতে বাবা " . গোরা কহিল, “না, আমি তাকে জানি নে । তার কথা লিখতে পারব না ।” হরিমোহিনী কাগজখানি যত্ন করিয়া মুড়িয়া আঁচলে বাধিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। সুচরিতা তখনো আনন্দময়ীর নিকট ললিতার বাড়িতে ছিল। সেখানে আলোচনার সুবিধা হইবে না এবং ললিতা ও আনন্দময়ীর নিকট হইতে বিরুদ্ধ কথা শুনিয়া তাহার মনে দ্বিধা জন্মিতে পারে আশঙ্কা করিয়া, সুচরিতাকে বলিয়া পঠাইলেন, পরদিন মধ্যাহ্নে সে যেন তাহার নিকটে আসিয়া আহার করে। বিশেষ প্রয়োজনীয় কথা আছে, আবার অপরাহােঁই সে চলিয়া যাইতে পারে। পরদিন মধ্যাহ্নে সুচরিতা মনকে কঠিন করিয়াই আসিল । সে জানিত তাহার মাসি তাহাকে এই বিবাহের কথাই আবার আর-কোনোরকম করিয়া বলিবেন । সে আজ তাহাকে অত্যন্ত শক্ত জবাব দিয়া কথাটা একেবারেই শেষ করিয়া দিবে। এই তাহার সংকল্প ছিল । সুচরিতার আহার শেষ হইলে হরিমোহিনী কহিলেন, “কাল সন্ধ্যার সময় আমি তোমার গুরুর ওখানে গিয়েছিলুম।” সুচরিতার অন্তঃকরণ কুষ্ঠিত হইয়া পড়িল । মাসি আবার কি তাহার কোনো কথা তুলিয়া তীহাকে অপমান করিয়া আসিয়াছেন । হরিমোহিনী কহিলেন, “ভয় নেই রাধারানী, আমি তীর সঙ্গে ঝগড়া করতে যাই নি। একলা ছিলুম, ভাবলুম যাই তার কাছে, দুটাে ভালো কথা শুনে আসি গে। কথায় কথায় তোমার কথাই উঠল। তা দেখলুম, তারও ঐ মত । মেয়েমানুষ যে বেশিদিন আইবুড়ো হয়ে থাকে এটা তো তিনি ভালো বলেন না। তিনি বলেন শাস্ত্ৰমতে ওটা অধৰ্ম। ওটা সাহেবদের ঘরে চলে, হিন্দুর ঘরে না। আমি তাকে আমাদের কৈলাসের কথাও খুলে বলেছি। দেখলুম লোকটি জ্ঞানী বটে ।” লজ্জায় কষ্টে সুচরিতা মৰ্মে মরিতে লাগিল । হরিমোহিনী কহিলেন, “তুমি তো তাকে গুরু বলে মানো । তার কথাটা তো পালন করতে হবে ।” সুচরিতা চুপ করিয়া রহিল। হরিমোহিনী কহিলেন, “আমি তাকে বললুম— বাবা, তুমি নিজে এসে তাকে বুঝিয়ে যাও, সে আমাদের কথা মানে না । তিনি বললেন, “না, তার সঙ্গে আমার আর দেখা হওয়া উচিত হবে না, ওটা আমাদের হিন্দুসমাজে বাধে ।’ আমি বললুম, তবে উপায় কী ? তখন তিনি আমাকে নিজের হাতে লিখে দিলেন । এই দেখো-না ।” এই বলিয়া হরিমোহিনী ধীরে ধীরে আঁচল হইতে কাগজটি খুলিয়া লইয়া তাহার ভাজ খুলিয়া সুচরিতার সম্মুখে মেলিয়া দিলেন । সুচরিতা পড়িল । তাহার যেন নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিল । সে কাঠের পুতুলের মতো আড়ষ্ট হইয়া বসিয়া রহিল । লেখাটির মধ্যে এমন কিছুই ছিল না যাহা নূতন বা অসংগত। কথাগুলির সহিত সুচরিতার মতের যে অনৈক্য আছে তাহাও নহে। কিন্তু হরিমোহিনীর হাত দিয়া বিশেষ করিয়া এই লিখনটি তাহাকে পঠাইয়া দেওয়ার যে অর্থ তাঁহাই সুচরিতাকে নানাপ্রকারে কষ্ট দিল । গোরার কােছ হইতে এ আদেশ আজ কেন ? অবশ্য, সুচরিতারও সময় উপস্থিত হইবে, তাহাকেও একদিন বিবাহ করিতে হইবেসেজন্য গোরার পক্ষে এত ত্বরান্বিত হইবার কি কারণ ঘটিয়াছে ? তাহার সম্বন্ধে গোরার কাজ একেবারে শেষ হইয়া গেছে ? সে কি গোরার কর্তব্যে কোনো হানি করিয়াছে, তাহার জীবনের পথে