পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ\ტრ0 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমার নিজের বুদ্ধির উপরে নির্ভর করতে বলী- আমার সে বুদ্ধি নেই, আমি মনের মধ্যে সে জোরও পাচ্ছি নে । তুমি আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো বাবা।” : এই বলিয়া সে পরেশের দিকে পিঠ করিয়া অত্যন্ত নতশিরে তেরঙ্গের কাপড় লইয়া পড়িল । তাহার চােখ দিয়া টপ টপ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। Գ (; গোরা লিখনটি লিখিয়া যখন হরিমোহিনীর হাতে দিল তখন তাহার মনে হইল সুচরিতা সম্বন্ধে সে যেন ত্যাগপত্র লিখিয়া দিল । কিন্তু দলিল লিখিয়া দিলেই তো তখনই কাজ শেষ হয় না । তাহার হৃদয় যে সে দলিলকে একেবারে অগ্রাহ্য করিয়া দিল । সে দলিলে কেবল গোরার ইচ্ছাশক্তি জোর কলমে নামসই করিয়া দিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহার হৃদয়ের স্বাক্ষর তো তাহাতে ছিল না— হৃদয় তাই অবাধ্য হইয়াই রহিল। এমনি ঘোরতর অবাধ্যতা যে, সেই রাত্রেই গোরাকে একবার সুচরিতার বাড়ির দিকে দৌড় করাইয়াছিল আর-কি! কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তেই গির্জার ঘড়িতে দশটা বাজিল এবং গোরার চৈতন্য হইল এখন কাহারও বাড়িতে গিয়া দেখা করিবার সময় নয়। তাহার পরে গির্জার প্রায় সকল ঘড়িই গোরা শুনিয়াছে। কারণ বালির বাগানে সে রাত্রে তাহার যাওয়া ঘটিল না। পরদিন প্রত্যুষে যাইবে বলিয়া সংবাদ পঠাইয়াছে। প্রত্যুষেই বাগানে গেল। কিন্তু যে প্রকার নির্মল ও বলশালী মন লইয়া সে প্রায়শ্চিত্ত গ্ৰহণ করিবে স্থির করিয়াছিল। সেরকম মনের অবস্থা তাহার কোথায় ? অধ্যাপক-পণ্ডিতেরা অনেকে আসিয়াছেন । আরো অনেকের আসিবার কথা । গোরা সকলের সংবাদ লইয়া সকলকে মিষ্টসম্ভাষণ করিয়া আসিল । তাহারা গোরার সনাতন ধর্মের প্রতি আচল নিষ্ঠার কথা বলিয়া বার বার সাধুবাদ করিলেন । বাগান ক্রমেই কোলাহলে পূর্ণ হইয়া উঠিল। গোরা চারিদিক তত্ত্বাবধান করিয়া বেড়াইতে লাগিল। কিন্তু সমস্ত কোলাহল এবং কাজের ব্যস্ততার মধ্যে গোরার হৃদয়ের নিগুঢ়তলে একটা কথা কেবলই বাজিতেছিল, কে যেন বলিতেছিল— ‘অন্যায় করেছ, অন্যায় করেছ।” অন্যায়টা কোনখানে তাহা তখন স্পষ্ট করিয়া চিন্তা করিয়া দেখিবার সময় ছিল না, কিন্তু কিছুতেই সে তাহার গভীর হৃদয়ের মুখ বন্ধ করিতে পারিল না। প্ৰায়শ্চিত্ত-অনুষ্ঠানের বিপুল আয়োজনের মাঝখানে তাহার হৃদয়বাসী কোন গৃহশত্রু তাহার বিরুদ্ধে আজ সাক্ষ্য দিতেছিল, বলিতেছিল- ‘অন্যায় রহিয়া গেল !!' এ অন্যায় এইজন্য গোরার সমস্ত অন্তঃকরণ এই অনুষ্ঠানের উদযোগ হইতে মুখ ফিরাইয়া ছিল। সময় নিকটবতী হইল, বাহিরে বঁাশের ঘের দিয়া পাল টাঙাইয়া সভাস্থান প্ৰস্তুত হইয়ােছ। গোরা গঙ্গায় স্নান করিয়া উঠিয়া কাপড় ছাড়িতেছে, এমন সময় জনতার মধ্যে একটা চঞ্চলতা অনুভব করিল। একটা যেন উদবেগ ক্রমশ চারি দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। অবশেষে অবিনাশ মুখ বিমর্ষ করিয়া কহিল, “আপনার বাড়ি থেকে খবর এসেছে। কৃষ্ণদয়ালবাবুর মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে। তিনি সত্বর আপনাকে আনবার জন্যে গাড়িতে করে লোক পাঠিয়েছেন।” গোরা তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল । অবিনাশ তাহার সঙ্গে যাইতে উদ্যত হইল। গোরা কহিল, “না, তুমি সকলের অভ্যর্থনায় থাকে- তুমি গেলে চলবে না।” গোরা কৃষ্ণদয়ালের ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, তিনি বিছানায় শুইয়া আছেন এবং আনন্দময়ী র্তাহার পায়ের কাছে বসিয়া ধীরে ধীরে তাহার পায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছেন। গোরা উদবিগ্ন হইয়া উভয়ের মুখের দিকে চাহিল। কৃষ্ণদয়াল ইঙ্গিত করিয়া পার্শ্ববর্তী চৌকিতে তাহায্যে বসিতে বলিলেন। গোরা বসিল । গোরা মাকে জিজ্ঞাসা করিল, “এখন কেমন আছেন ?” আনন্দময়ী কহিলেন, “এখন একটু ভালোই আছেন। সাহেব-ডাক্তার ডাকতে গেছে।”