পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা とと> কের শশিভূখী এবং একজন চকর ছিল। কৃষ্ণায়াল হাত বািডয়া তাহাদিগকে কিয় করিয়া যখন দেখিলেন সকলে চলিয়া গেল তখন তিনি নীরবে আনন্দময়ীর মুখের দিকে চাহিলেন, এবং গোরাকে মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, “আমার সময় হয়ে এসেছে। এতদিন তোমার কাছে যা গোপন ছিল আজ তোমাকে তা না বলে গেলে আমার মুক্তি হবে না।” গোরার মুখ বিবৰ্ণ হইয়া গেল। সে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল, অনেকক্ষণকেহ কোনো কথা কহিল না। কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “গোরা, তখন আমি কিছু মানতুম না— সেইজন্যই এতবড়ো ভুল করেছি, তার পরে আর ভ্ৰমসংশোধনের পথ ছিল না ।” এই বলিয়া আবার চুপ করিলেন। গোরাও কোনো প্রশ্ন না করিয়া নিশ্চল হইয়া বসিয়া রহিল । কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “মনে করেছিলুম, কোনোদিনই তোমাকে বলবার আবশ্যক হবে না, যেমন চলছে এমনিই চলে যাবে। কিন্তু এখন দেখছি, সে হবার জো নেই। আমার মৃত্যুর পরে তুমি আমার শ্ৰাদ্ধ করবে। কী করে !” এরূপ প্রমাদের সম্ভাবনামাত্রে কৃষ্ণদয়াল যেন শিহরিয়া উঠিলেন। আসল কথাটা কী তাহা জানিবার জন্য গোরা অধীর হইয়া উঠিল। সে আনন্দময়ীর দিকে চাহিয়া কহিল, “মা, তুমি বলে। কথাটা কী । শ্ৰাদ্ধ করবার অধিকার আমার নেই ?” আনন্দময়ী এতক্ষণ মুখ নত করিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিলেন ; গোরার প্রশ্ন শুনিয়া তিনি মাথা তুলিলেন এবং গোরার মুখের উপর দৃষ্টি স্থির রাখিয়া কহিলেন, “না, বাবা, নেই।” গোরা চকিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “আমি ওঁর পুত্র নই ?” আনন্দময়ী কহিলেন, “না।” অগ্নিগিরির অগ্নি-উচ্ছাসের মতো তখন গোরার মুখ দিয়া বাহির হইল, “মা, তুমি আমার মানও ?” আনন্দময়ীর বুক ফাটিয়া গেল ; তিনি অশ্রুহীন রোদনের কণ্ঠে কহিলেন, “বাবা, গোরা, তুই যে আমার পুত্রহীনার পুত্র, তুই যে গর্ভের ছেলের চেয়ে অনেক বেশি বাবা ?” গোরা তখন কৃষ্ণদয়ালের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “আমাকে তবে তোমরা কোথায় পেলে ?” কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “তখন মিউটিনি। আমরা এটােয়াতে । তোমার মা সিপাহিদের ভয়ে পালিয়ে এসে রাত্রে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন । তোমার বাপ তার আগের দিনেই লড়াইয়ে মারা গিয়েছিলেন । তার নাম ছিল--” গোরা গর্জন করিয়া বলিয়া উঠিল, “দরকার নেই তার নাম । আমি নাম জানতে চাই নে ৷” কৃষ্ণদয়াল গোরার এই উত্তেজনায় বিস্মিত হইয়া থামিয়া গেলেন। তার পর বলিলেন, “তিনি আইরিশম্যান ছিলেন । সেই রাত্ৰেই তোমার মা তোমাকে প্রসব করে মারা গেলেন । তার পর থেকেই তুমি আমাদের ঘরে মানুষ হয়েছ।” এক মুহুর্তেই গােরার কাছে তাহার সমস্ত জীবন অত্যন্ত অদ্ভুত একটা স্বপ্নের মতো হইয়া গেল। শৈশব হইতে এত বৎসর তাহার জীবনের যে ভিত্তি গড়িয়া উঠিয়াছিল তাহা একেবারেই বিলীন হইয়া গেল। সে যে কী, সে যে কোথায় আছে, তাহা যেন বুঝিতেই পারিল না। তাহার পশ্চাতে অতীতকাল বলিয়া যেন কোনো পদার্থই নাই এবং তাহার সম্মুখে তাহার এতকালের এমন একাগ্রলক্ষবর্তী সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গেছে। সে যেন কেবল এক মুহূর্ত-মাত্রের পদ্মাপত্রে শিশিরবিন্দুর মতো ভাসিতেছে। তাহার মা নাই, বাপ নাই, দেশ নাই, জাতি নাই, নাম নাই, গোত্র নাই, দেবতা নাই | তাহার সমস্তই একটা কেবল “ন’ । সে কী ধরিবে, কী করিবে, আবার কোথা হইতে শুরু করবে, আবার কোন দিকে লক্ষ স্থির করিবে, আবার দিনে দিনে ক্রমে ক্রমে কর্মের উপকরণ-সকল কোথা হইতে কেমন করিয়া সংগ্ৰহ করিয়া তুলিবে! এই দিকচিহ্নহীন অদ্ভুত শূন্যের মধ্যে গােরা নির্বািক হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার মুখ দেখিয়া কেহ তাহাকে আর দ্বিতীয় কথাটি বলিতে সাহস করিল না। এমন সময় পরিবারের বাঙালি চিকিৎসকের সঙ্গে সাহেব-ডাক্তার আসিয়া উপস্থিত হইল। ডাক্তার