পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

とbrミ রবীন্দ্র-রচনাবলী করিতে মুহূৰ্তমাত্র সময় লয় না। ইন্দ্ৰিয়ের অসন্দিগ্ধ সাক্ষা লইয়া মন তাহার সৌন্দর্য স্বীকার করিতে কিছুমাত্র তর্ক করে না। তাহা আমাদের মনের নিজের আবিষ্কার নহে, ইন্দ্ৰিয়ের নিকট হইতে পাওয়া। এইজন্য মন তাহাকে অবজ্ঞা করে ; বলে, ও নিতান্তই মিষ্ট, কেবলই মিষ্ট। অর্থাৎ উহার মিষ্টতা বুঝিতে অন্তঃকরণের কোনো প্রয়োজন হয় না, কেবলমাত্র ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারাই বোঝা যায় । যাহারা গানের সমজদার এইজন্যই তাহারা অত্যন্ত উপেক্ষা প্রকাশ করিয়া বলে, অমুক লোক মিষ্ট গান করে। ভাবটা এই যে, মিষ্ট গায়ক গানকে আমাদের ইন্দ্ৰিয়সভায় আনিয়া নিতান্ত সুলভ প্রশংসা দ্বারা অপমানিত করে ; মার্জিত রুচি ও শিক্ষিত মনের দরবারে সে প্রবেশ করে না । যে লোক পাটের অভিজ্ঞ যাচনদার সে রসসিক্ত পাট চায় না ; সে বলে, আমাকে শুকনো পাট দাও, তবেই আমি ঠিক ওজনটা বুঝিব। গানের উপযুক্ত সমজদার বলে, বাজে রস দিয়া গানের বাজে গৌরব বাড়াইয়ে না, আমাকে শুকনাে মাল দাও, তবেই আমি ঠিক ওজনটি পাইব, আমি খুশি হইয়া ঠিক দামটি চুকাইয়া দিব । বাহিরের বাজে মিষ্টতায় আসল জিনিসের মূল্য নামাইয়া দেয়। যাহা সহজেই মিষ্ট তাহাতে অতি শীঘ্ৰ মনের আলস্য আনে, বেশিক্ষণ মনােযোগ থাকে না। অবিলম্বেই তাহার সীমায় উত্তীর্ণ হইয়া মন বলে, আর কেন, ঢের হইয়াছে। এইজন্য যে লোক যে বিষয়ে বিশেষ শিক্ষা লাভ করিয়াছে সে তাহার গোড়ার দিককার নিতান্ত সহজ ও ললিত অংশকে আর খাতির করে না। কারণ, সেটুকুর সীমা সে জানিয়া লইয়াছে ; সেটুকুর দৌড় যে বেশিদূর নহে তাহা সে বােঝে ; এইজন্য তাহার অন্তঃকরণ তাঁহাতে জাগে না । অশিক্ষিত সেই সহজ অংশটুকুই বুঝিতে পারে, অথচ তখনো সে তাহার সীমা পায় না— এইজন্যই সেই অগভীর অংশেই তাহার একমাত্র আনন্দ । সমজদারের আনন্দকে সে একটা কিন্তুত ব্যাপার বলিয়া মনে করে, অনেক সময় তাহাকে কপটতার আড়ম্বর বলিয়াও গণ্য করিয়া থাকে। এইজন্যই সর্বপ্রকার কলাবিদ্যাসম্বন্ধে শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের আনন্দ ভিন্ন ভিন্ন পথে যায় । তখন এক পক্ষ বলে, তুমি কী বুঝিবে !! আর-এক পক্ষ রাগ করিয়া বলে, যাহা বুঝিবার তাহা কেবল তুমিই বোঝ, জগতে আর-কেহ বোঝে না | একটি সুগভীর সামঞ্জস্যের আনন্দ, সংস্থান-সমাবেশের আনন্দ, দূরবতীর সহিত যোগ-সংযোগের আনন্দ, পাশ্ববতীর সহিত বৈচিত্ৰ্যসাধনের আনন্দ- এইগুলি মানসিক আনন্দ । ভিতরে প্রবেশ না করিলে, না বুঝিলে, এ আনন্দ ভোগ করিবার উপায় নাই। উপর হইতেই চট্ট করিয়া যে সুখ পাওয়া যায়, ইহা তাহা অপেক্ষা স্থায়ী ও গভীর । এবং এক হিসাবে তাহা অপেক্ষা ব্যাপক । যাহা অগভীর, লোকের শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে, অভ্যাসের সঙ্গে ক্রমেই তাহা ক্ষয় হইয়া তাহার রিক্ততা বাহির হইয়া পড়ে । যাহা গভীর তাহা আপাতত বহুলোকের গম্য না হইলেও বহুকাল তাহার পরমায়ু থাকে, তাহার মধ্যে যে-একটি শ্রেষ্ঠতার আদর্শ আছে তাহা সহজে জীৰ্ণ হয় না । জয়দেবের “ললিতলবঙ্গলতী’ ভালো বটে, কিন্তু বেশিক্ষণ নহে। ইন্দ্ৰিয় তাহাকে মন-মহারাজের কাছে নিবেদন করে, মন তাহাকে একবার স্পর্শ করিয়াই রাখিয়া দেয়— তখন তাহা ইন্দ্ৰিয়ের ভোগেই শেষ হইয়া যায়। “ললিতলবঙ্গলতার পাৰ্থে কুমারসম্ভবের একটা শ্লোক ধরিয়া দেখা যাক আবর্জিত কিঞ্চিদিব স্তনাভ্যাঃ বাসে বসােনা তরুণার্করাগম | পর্যাপ্তপুষ্পস্তবকাবনম্র সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতেব । v ছন্দ আলুলায়িত নহে, কথাগুলি যুক্তাক্ষরবহুল ; তবু ভ্ৰম হয়, এই শ্লোক “ললিতলবঙ্গলতার অপেক্ষা কানেও মিষ্ট শুনাইতেছে। কিন্তু তাহা ভ্ৰম । মন নিজের সৃজনশক্তির দ্বারা ইন্দ্ৰিয়সুখ পূরণ করিয়া দিতেছে। যেখানে লোলুপ ইন্দ্ৰিয়গণ ভিড় করিয়া না দাঁড়ায় সেইখনেই মন এইরূপ সৃজনের অবসর পায় । ‘পর্যাপ্তপুষ্পস্তবকাবনম্রা— ইহার মধ্যে লয়ের যে উত্থান আছে, কঠোরে কোমলে