পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brbr রবীন্দ্র-রচনাবলীט\ তাড়নায় আমি মনে করি আমাকে উপকার করিতেই হইবে, কাজে লাগিতেই হইবে, তবে যে উৎকট ব্যর্থতার সৃষ্টি করি, তাহা আমার স্বকৃত । তাহার জবাবদিহি আমাকে করিতে হইবে। পরের উপকার করিতে সকলেই জন্মাই নাই, অতএব উপকার না করিলে লজ্জা নাই। মিশনারি হইয়া চীন উদ্ধা করিতে না-ই গেলাম ; দেশে থাকিয়া শেয়াল শিকার করিয়া ও ঘোড়দৌড়ে জুয়া খেলিয়া দিন-কাটানোকে যদি ব্যর্থতা বল, তবে তাহা চীন-উদ্ধার-চেষ্টার মতো এমন লোমহর্ষক নিদারুণ ব্যৰ্থতা নহে । সকল ঘাস ধান হয় না। পৃথিবীতে ঘাসই প্রায় সমস্ত, ধান অল্পই। কিন্তু ঘাস যেন আপনার স্বাভাবিক নিস্ফলতা লইয়া বিলাপ না করে— সে যেন স্মরণ করে যে, পৃথিবীর শুষ্ক৷ ধূলিকে গে শ্যামলতার দ্বারা আচ্ছন্ন করিতেছে, রৌদ্রতাপকে সে চিরপ্রসন্ন স্নিগ্ধতার দ্বারা কোমল করিয়া লইতেছে। বোধ করি ঘাসজাতির মধ্যে কুশতৃণ গায়ের জোরে ধান্য হইবার চেষ্টা করিয়াছিল ; বেঃ করি। সামান্য ঘাস হইয়া না থাকিবার জন্য, পরের প্রতি একান্ত মনোনিবেশ করিয়া জীবনকে সার্থক করিবার জন্য, তাহার মধ্যে অনেক উত্তেজনা জন্মিয়ছিল ; তবু সে ধান্য হইল না। কিন্তু সর্বদা পরের প্রতি তাহার তীক্ষ লক্ষ নিবিষ্ট করিবার একাগ্র চেষ্টা কিরূপ তাহ পরই বুঝিতেছে। মোটের উপর এ কথা বলা যাইতে পারে যে, এরূপ উগ্র পরপরায়ণতা বিধাতার অভিপ্রেত নহে। ইহা অপেক্ষা সাধারণ তৃণের খ্যাতিহীন স্নিগ্ধসুন্দর বিনম্র-কোমল নিস্ফলতা ভালো । সংক্ষেপে বলিতে গেলে মানুষ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত- পনেরো-আনা এবং বাকি এক-আনা । পনেরো-আনা শান্ত এবং এক-আনা অশান্ত | পনেরো-আনা অনাবশ্যক এবং এক-আনা আবশ্যক | বাতাসে চলনশীল জুলনধমী অক্সিজেনের পরিমাণ অল্প, স্থির শান্ত নাইট্রোজেনই অনেক । যদি তাহার উলটা হয় তবে পৃথিবী জুলিয়া ছাই হয় । তেমনি সংসারে, যখন কোনো এক-দল পনেরো-আনা এক-আনার মতোই অশান্ত ও আবশ্যক হইয়া উঠিবার উপক্রম করে তখন জগতে আর কল্যাণ নাই, তখন যাহাদের অদৃষ্ট মরণ আছে তাহাদিগকে মরিবার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। ᎼᎢᎸ ᏚᏔᏍOᎣ ത്. নববষা যৌবনে নিজের অন্ত পাই নাই, সংসারেরও অন্ত ছিল না । আমি কী যে হইব না হইব, কী করিতে পারি না পারি, কাজে ভাবে অনুভাবে আমার প্রকৃতির দৌড় কতদূর, তাহা নির্দিষ্ট হয় নাই, সংসােরও অনির্দিষ্ট রহস্যপূর্ণ ছিল। এখন নিজের সম্বন্ধে সকল সম্ভাবনার সীমায় আসিয়া পৌঁছিয়ছি, পৃথিবীও সেইসঙ্গে সংকুচিত হইয়া গেছে"। এখন ইহা আমারই আপিস-ঘর বৈঠকখানা—দরাদালানের শামিল হইয়া পড়িয়াছে। সেইভাবেই পৃথিবী এত বেশি অভ্যস্ত পরিচিত হইয়া গেছে যে ভুলিয়া গেছি। এমন কত আপিস-ঘর বৈঠকখানা-দরদালান ছায়ার মতো এই পৃথিবীর উপর দিয়া গেছে, ইহাতে চিহ্ন% রাখিতে পারে নাই। কত প্রৌঢ় নিজের মামলা-মকদ্দমার মন্ত্ৰগৃহকেই পৃথিবীর ধ্রুব কেন্দ্ৰস্থল গণ৷ করিয়া তাকিয়ার উপর ঠেসান দিয়া বসিয়া ছিল, তাহাদের নাম তাহাদের ভস্মের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে উড়িয়া গেছে, সে এখন আর খুঁজিয়া পাইবার জো নাই— তবু পৃথিবী সমান বেগে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিয়া চলিতেছে। কিন্তু আষাঢ়ের মেঘ প্রতিবৎসর যখনই আসে তখনই তাহার নূতনত্বে রসাত্ৰান্ত ও পুরাতনহে, পুঞ্জীভূত হইয়া আসে। তাহাকে আমরা ভুল করি না, কারণ সে আমাদের ব্যবহারের বাহিরে থাকে। আমার সংকোচের সঙ্গে সে সংকুচিত হয় না। যখন বন্ধুর দ্বারা বঞ্চিত, শত্রুর দ্বারা পীড়িত, দূরদৃষ্ট্রি দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছি, তখন যে কেবল হৃদয়ের মধ্যে বেদনার চিহ্ন লাগিয়াছে, ললাটের উপর বর্দি অঙ্কিত হইয়াছে, তাহা নহে- যে পৃথিবী আমার চারি দিকে স্থির হইয়া দাড়াইয়া আছে, আমঠু আঘাতের দাগ তাহার উপর পড়িয়ছে। তাহার জলস্থল আমার বেদনায় বিক্ষত, আমার দুশ্চিন্ত{