পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტპ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়া আমি উপদেশ দিতে বসিয়াছি। সন্দেহ একেবারেই অমূলক বলা যায় না। অভ্যাস খারাপ হইয়া গেছে । আমি এই বলিতেছিলাম যে, অভিব্যক্তির শেষ কোঠায় আসিয়া পড়াতে মানুষের মধ্যে অনেক ভাগ ঘটিয়াছে। জড়ভাগ, উদ্ভিদভাগ, পশুভাগ, বর্বরভাগ, সভ্যভাগ, দেবভাগ ইত্যাদি। এই ভিন্ন ভিন্ন ভাগের এক-একটা বিশেষ জন্মঋতু আছে। কোন ঋতুতে কোন ভাগ পড়ে তাহা নির্ণয় করিবার ভার আমি লইব না । একটা সিদ্ধান্তকে শেষ পর্যন্ত মিলাইয়া দিব পণ করিলে বিস্তর মিথ্যা বলিতে হয় । বলিতে রাজি আছি ; কিন্তু এত পরিশ্রম আজ পারিব না । 亚 দীর্ঘ শীতের পর আজ মধ্যাহ্নে প্রাস্তরের মধ্যে নববসন্ত নিশ্বসিত হইয়া উঠিতেই নিজের মধ্যে মনুষ্যজীবনের ভারি একটা অসামঞ্জস্য অনুভব করিতেছি। বিপুলের সহিত, সমগ্রের সহিত তাহার সুর মিলিতেছে না। শীতকালে আমার উপরে পৃথিবীর যে-সমস্ত তাগিদ ছিল আজও ঠিক সেই সব তাগিদই চলিতেছে। ঋতু বিচিত্র, কিন্তু কাজ সেই একই। মনটাকে ঋতুপরিবর্তনের উপরে জয়ী করিয়া তাহাকে অসাড় করিয়া যেন মস্ত একটা কী বাহাদুরী আছে। মন মস্ত লোক, সে কী না পারে। সে দক্ষিনে হাওয়াকেও সম্পূৰ্ণ অগ্রাহ্য করিয়া হন হন করিয়া বড়োবাজারে ছুটিয়া চলিয়া যাইতে পারে। পারে স্বীকার করিলাম, কিন্তু তাই বলিয়াই কি সেটা তাহাকে করিতেই হইবে ? তাহাতে দক্ষিনে বাতাস বাসায় গিয়া মরিয়া থাকিবে না, কিন্তু ক্ষতিটা কাহার হইবে ? এই তো অল্পদিন হইল, আমাদের আমলকী মউল ও শালের ডাল হইতে খসি খসি করিয়া কেবলই পাতা খসিয়া পড়িতেছিল— ফায়ুন দূরাগত পথিকের মতো যেমনি দ্বারের কাছে আসিয়া একটা হাঁপ ছাড়িয়া বসিয়াছে মাত্র, অমনি আমাদের বনশ্রেণী পাতা-খসানোর কাজ বন্ধ করিয়া দিয়া একেবারে রাতারাতিই কিসলয় গজাইতে শুরু করিয়া দিয়াছে। আমরা মানুষ, আমাদের সেটি হইবার জো নাই। বাহিরে চারি দিকেই যখন হাওয়া-বদল, পাত-বদল, রঙ-বদল, আমরা তখনো গোরুর গাড়ির বাহনটার মতো পশ্চাতে পুরাতনের ভারাক্রান্ত জের সমানভাবে টানিয়া লইয়া একটানা রাস্তায় ধূলা উড়াইয়া চলিয়াছি। বাহক তখনাে যে লড়ি লইয়া পাজরে ঠেলিতেছিল এখনো সেই লড়ি । হাতের কাছে পঞ্জিকা নাই, অনুমানে বােধ হইতেছে আজ ফায়ুনের প্রায় পনরোই কি ষোলোই হইবে- বসন্তলক্ষ্মী আজ ষোড়শী কিশোরী। কিন্তু তবু আজও হস্তায় হস্তায় খবরের কাগজ বাহির হইতেছে ; পড়িয়া দেখি, আমাদের কর্তৃপক্ষ আমাদের হিতের জন্য আইন তৈরি করিতে সমােনই ব্যস্ত এবং অপর পক্ষ তাঁহারই তন্ন তন্ন বিচারে প্রবৃত্ত। বিশ্বজগতে এইগুলাই যে সর্বোচ্চ ব্যাপার নয়— বড়েলাট ছোটােলাট সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদকের উৎকট ব্যস্ততাকে কিছুমাত্র গণ্য না করিয়া দক্ষিণসমুদ্রের তরঙ্গোৎসবসভা হইতে প্রতিবৎসরের সেই চিরন্তন বার্তাবহ নবজীবনের আনন্দসমাচার লইয়া ধরাতলে অক্ষয় প্রাণের আশ্বাস নূতন করিয়া প্রচার করিতে বাহির হয়, এটা মানুষের পক্ষে কম কথা নয়, কিন্তু এ-সব কথা ভাবিবার জন্য আমাদের ছুটি নাই। সেকালে আমাদের মেঘ ডাকিলে অনধ্যায় ছিল, বর্ষার সময় প্রবাসীরা বাড়ি ফিরিয়া আসিতেন । বাদলার দিনে যে পড়া যায় না বা বর্ষার সময় বিদেশে কাজ করা অসম্ভব। এ কথা বলিতে পারি নামানুষ স্বাধীন স্বতন্ত্র, মানুষ জড়প্রকৃতির আঁচল ধরা নয়। কিন্তু জোর আছে বলিয়াই বিপুল প্রকৃতির সঙ্গে ক্রমাগত বিদ্রোহ করিয়াই চলিতে হইবে, এমন কী কথা আছে। বিশ্বের সহিত মানুষ নিজের কুটুম্বিতা স্বীকার করিলে, আকাশে নবনীলাঞ্জন মেঘ্যোদয়ের খাতিরে পড়া বন্ধ ও কাজ বন্ধ করিলে, দক্ষিনে হাওয়ার প্রতি একটুখানি শ্রদ্ধা রক্ষা করিয়া আইনের সমালোচনা বন্ধ রাখিলে, মানুষ জগৎচরাচরের মধ্যে একটা বেসুরের মতো বাজিতে থাকে না। পাঁজিতে তিথিবিশেষে বেগুন শিম কুন্মাণ্ড নিষিদ্ধ আছে; আরো কতকগুলি নিষেধ থাকা দরকার- কোন ঋতুতে খবরের কাগজ পড়া