পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vesbit রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রভাবে তাঁহাদের প্রতি পদক্ষেপের শ্রান্তি দূর হইয়া যায়। জননীর স্নেহের ন্যায় জগতের শোভা সমস্ত পথ তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে চলিতে থাকে, হৃদয়ের অন্ধকার অন্তঃপুর হইতে তাহাদিগকে বাহিরে ডাকিয়া আনে, পশ্চাৎ হইতে সম্মুখের দিকে তাহাদিগকে আলিঙ্গন করিয়া লইয়া যায়। প্ৰেম যদি কেহ বাধিয়া রাখিতে পারিত তবে পথিকদের যাত্রা বন্ধ হইত। প্রেমের যদি কোথাও সমাধি হইত, তবে পথিক সেই সমাধির উপরে জড় পাষাণের মতো চিহ্নের স্বরূপ পড়িয়া থাকিত । নীেকার গুণ যেমন নীেকাকে বাধিয়া লইয়া যায়, যথার্থ প্ৰেম তেমনি কাহাকেও বাধিয়া রাখিয়া দেয় না, কিন্তু বাধিয়া লইয়া যায়। প্রেমের বন্ধনের টানে আর-সমস্ত বন্ধন ছিড়িয়া যায়। বৃহৎ প্রেমের প্রভাবে ভূগ্রেহের সূত্ৰসকলচুটিয়া হয়। জগৎ তাই চলিতেছে নহিলে আপনার ভারে আপনি অচল হইয়া ○ | পথিকেরা যখন চলে আমি বাতায়ন হইতে তাহাদের হাসি দেখি, কান্না শুনি । যে প্ৰেম কাদায় সেই প্রেমই আবার চােখের জল মুছাইয়া দেয়, হাসির আলো ফুটাইয়া তোলে। হাসিতে অশ্রুতে, আলোতে বৃষ্টিতে আমাদের চারিদিকে সৌন্দর্যের উপবন প্রফুল্ল করিয়া রাখে। প্রেম কাহাকেও চিরদিন কঁাদিতে দেয় না । যে প্ৰেম একের বিরহে তোমাকে কাদায় সেই প্রেমই আর পাচকে তোমার কাছে আনিয়া দেয় ; প্রেম বলে, “একবার ভালো করিয়া চাহিয়া দেখো, যে গেছে ইহারা তাহার অপেক্ষা কিছুমাত্র কম নহে ।” কিন্তু তুমি অশ্রুজলে অন্ধ, তুমি আর-কাহাকেও দেখিতে পাও না, তাই ভালোবাসিতে পার না। তুমি তখন মরিতে চাও, সংসারের কাজ করিতে পার না। তুমি পিছন ফিরিয়া বসিয়া থাক, জগতে যাত্রা করিতে চাও না । কিন্তু অবশেষে প্রেমের জয় হয়, প্ৰেম তোমাকে টানিয়া লইয়া যায়, তুমি মৃত্যুর উপরে মুখ গুজিয়া চিরদিন পড়িয়া থাকিতে পার না। প্ৰভাতে যাহারা প্ৰফুল্লাহৃদয়ে যাত্রা করিয়া বাহির হয় তাহাদিগকে অনেক দূরে যাইতে হইবে। অনেক অনেক দূর | পথের উপরে যদি তাহাদের ভালোবাসা না থাকিত তবে তাহারা এ দীর্ঘ পথ চলিতে পারিত না। পথ ভালােবাসে বলিয়াই প্রতি পদক্ষেপেই তাহাদের তৃপ্তি। এই পথ ভালােবাসে বলিয়াই তাহারা চলে, আবার এই পথ ভালোবাসে বলিয়াই তাহারা চলিতে চাহে না । তাহারা পা উঠাইতে চাহে না । প্রতি পদে তাহাদের ভ্ৰম হয়। যেমন পাইয়াছি এমন আর পাইব না, কিন্তু অগ্রসর হইয়াই আবার সমস্ত ভুলিয়া যায়। প্রতি পদে তাহারা শোক মুছিয়া মুছিয়া চলে। তাহারা আগেভাগে আশঙ্কা করিয়া বসে বলিয়াই কাদে, নহিলে কান্দিবার কোনো কারণ নাই । ঐ দেখো, কচি ছেলেটিকে বুকে করিয়া মা সংসারের পথে চলিয়াছে। ঐ ছেলেটির উপরে মাকে কে বাধিয়াছে ? ঐ ছেলেটিকে দিয়া মাকে কে টানিয়া লইয়া যাইতেছে ? প্রেমের প্রভাবে পথের কাটা মায়ের পায়ের তলে কেমন ফুল হইয়া উঠিতেছে। ছেলেটিকে মায়ের কোলে দিয়া পথকে গৃহের মতো মধুর করিয়াছে কে ? কিন্তু হায়, মা ভুল বোঝে কেন ? মা কেন মনে করে এই ছেলেটির মধ্যেই তাহার অনন্তের অবসান ? অনন্তের পথে যেখানে পৃথিবীর সকল ছেলে মিলিয়া খেলা করে, একটি ছেলে মায়ের হাত ধরিয়া মাকে সেই ছেলের রাজ্যে লইয়া যায়— সেখানে শতকোটি সস্তান । সেখানে বিশ্বের কচি মুখগুলি ফুটিয়া একেবারে নন্দনবান করিয়া রাখিয়াছে। আকাশের চাদকে কড়াকড়ি করিয়া লইবার জন্য কী আগ্রহ। সেখানে স্মৃলিত মধুর ভাষার কল্লোল। আবার ও দিকে শোনোসুকুমার অসহায়েরা কী কান্নাই কঁদিতেছে। শিশুদেহে রোগ প্রবেশ করিয়া ফুলের পাপড়ির মতো কোমল তনুগুলি জীর্ণ করিয়া ফেলিতেছে। কোমল কণ্ঠ হইতে স্বর বাহির হইতেছে না ; ক্ষীণস্বরে কঁদিতে চেষ্টা করিতেছে, কান্না কণ্ঠের মধ্যেই মিলাইয়া যাইতেছে। আর, ঐ শিশুদের প্রতি বর্বর বয়স্কদের কত অত্যাচার ! একটি ছেলে আসিয়া মাকে পৃথিবীর সকল ছেলের মা করিয়া দেয়। যার ছেলে নাই তার কাছে অনন্ত স্বর্গের একটা দ্বার রুদ্ধ, ছেলেটি আসিয়া স্বর্গের সেই দ্বারটি খুলিয়া দেয় ; তার পর তুমি চলিয়া যাও, সেও চলিয়া যাক । তার কাজ ফুরাইল, তার অন্য কাজ আছে। প্ৰেম আমাদিগকে ভিতর হইতে বাহিরে লইয়া যায়, আপন হইতে অন্যের দিকে লইয়া যায়, এক