পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ ዓ O S রাত্রিটা কোনোমতে জাগিয়া, ঘুমাইয়া, পাশ ফিরিয়া কাটিয়া গেল। জাগিয়া উঠিয়া দেখি বামে ঘনপত্রময় বন । গাছে গাছে লতা, ভূমি নানাবিধ গুলো আচ্ছন্ন। বনের মাথার উপর দিয়া দূর পাহাড়ের নীল শিখর দেখা যাইতেছে। মস্ত মস্ত পাথর। পাথরের ফাটলে এক-একটা গাছ ; তাহাদের ক্ষুধিত শিকড়গুলো দীর্ঘ হইয়া চারি দিক হইতে বাহির হইয়া পড়িয়াছে, পাথরখানাকে বিদীর্ণ করিয়া তাহারা কঠিন মুঠি দিয়া খাদ্য আঁকড়িয়া ধরিতে চায়। সহসা বামে জঙ্গল কোথায় গেল। সুদূরবিস্তৃত মাঠ। দূরে গোরু চরিতেছে, তাহাদিগকে ছাগলের মতো ছােটাে ছোটাে দেখাইতেছে। মহিষ কিংবা গোরুর কাধে লাঙল দিয়া পশুর লাঙ্গুল মলিয়া চাষার চাষ করিতেছে। চাষী মাঠ বামে পাহাড়ের উপর সোপানে সোপানে থাকে থাকে উঠিয়াছে। বেলা তিনটার সময় হাজারিবাগের ডাকবাংলায় আসিয়া পৌছিলাম | প্রশস্ত প্ৰান্তরের মধ্যে হাজারিবাগ শহরটি অতি পরিষ্কার দেখা যাইতেছে। শাহরিক ভােব বড়ো নাই। গলিখুঁজি, আবর্জনা, নর্দমা, ঘেঁষাৰ্ঘেষি, গোলমাল, গাড়িঘোড়া, ধুলোেকাদা, মাছিমশা, এ-সকলের প্রাদুর্ভাব বড়ো নাই ; মাঠ পাহাড় গাছপালার মধ্যে শহরটি তকতক করিতেছে। এক দিন কাটিয়া গেল। এখন দুপুর বেলা। ডাকবাংলার বারান্দার সম্মুখে কেদারায় একলা চুপ করিয়া বসিয়া আছি। আকাশ সুনীল । দুইখণ্ড শীর্ণ মেঘ সাদা পাল তুলিয়া চলিয়াছে। অল্প অল্প বাতাস আসিতেছে। একরকম মেঠো-মেঠো ঘেসো-ঘেসো গন্ধ পাওয়া যাইতেছে। বারান্দার চালের উপর একটা কাঠবিড়ালি। দুইটা শালিখ বারান্দায় আসিয়া চকিতভাবে পুচ্ছ নাচাইয়া লাফাইতেছে। পাশের রাস্তা দিয়া গোরু লইয়া যাইতেছে, তাহাদের গলার ঘণ্টার ঠুং ঠুং শব্দ শুনিতেছি। লোকজনেরা কেউ ছাতা মাথায় দিয়া, কেউ কাধে মোট লইয়া, কেউ দু-একটা গোরু তাড়াইয়া, কেউ একটা ছোটাে টাটুর উপর চড়িয়া, রাস্তা দিয়া অতি ধীরে-সুস্থে চলিতেছে ; কোলাহল নাই, ব্যস্ততা নাই, মুখে ভাবনার চিহ্ন নাই। দেখিলে মনে হয় এখানকার মানবজীবন দ্রুত এঞ্জিনের মতো ইহাসফাস করিয়া অথবা গুরুভারাক্রান্ত গোরুর গাড়ির চাকার মতো আর্তনাদ করিতে করিতে চলিতেছে না । গাছের তলা দিয়া দিয়া একটুখানি শীতল নিঝর যেমন ছায়ায় ছায়ায় কুল কুল করিয়া যায়, জীবন তেমনি করিয়া যাইতেছে। সমুখে ঐ আদালত। কিন্তু এখানকার আদালতও তেমন কঠোরমূর্তি নয়। ভিতরে যখন উকিলে উকিলে শামলায় শামলায় লড়াই বাধিয়াছে তখন বাহিরের অশথ গাছ হইতে দুই পাপিয়ার অবিশ্রাম উত্তর-প্রত্যুত্তর চলিতেছে। বিচারপ্রার্থী লোকেরা আমগাছের ছায়ায় বসিয়া জটলা করিয়া হাহা করিয়া হাসিতেছে, এখান হইতে শুনিতে পাইতেছি । মাঝে মাঝে আদালত হইতে মধ্যাহ্নের ঘণ্টা বাজিতেছে। চারিদিকে যখন জীবনের মৃদুমন্দ গতি তখন এই ঘণ্টার শব্দ শুনিলে টের পাওয়া যায় যে শৈথিল্যের স্রোতে সময় ভাসিয়া যায় নাই, সময় মাঝখানে দাড়াইয়া প্ৰতি ঘণ্টায় লীেহকণ্ঠে বলিতেছে, ‘আর কেহ জাগুক না-জাগুক আমি জাগিয়া আছি।” কিন্তু লেখকের অবস্থা ঠিক সেরূপ নয় । আমার চোখে তন্দ্ৰা আসিতেছে। আষাঢ় ১২৯২ সরোজিনী-প্ৰয়াণ অসমাপ্ত বিবরণ ১১ই জ্যৈষ্ঠ শুক্রবার। ইংরাজি ২৩শে মে ১৮৮৪ খৃস্টােব্দ । আজ শুভলগ্নে সরোজিনী' বাষ্পীয় পোত তাহার দুই সহচরী লীেহতরী দুই পার্থে লইয়া বরিশালে তাহার কর্মস্থানের উদ্দেশে যাত্রা করিবে । যাত্রীর দল বাড়িল ; কথা ছিল আমরা তিনজনে যাইব- তিনটি বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষমানুষ । সকালে উঠিয়া জিনিসপত্র বঁাধিয়া প্ৰস্তুত হইয়া আছি, পরমপরিহসনীয়া শ্ৰীমতী ভ্ৰাতৃজায়া-ঠাকুরানীর নিকটে স্নানমুখে বিদায় লইবার জন্য সমস্ত উদযোগ করিতেছি, এমন সময় শুনা গেল। তিনি সসন্তানে আমাদের অনুবর্তিনী হইবেন । তিনি কার মুখে শুনিয়াছেন যে, আমরা যে পথে যাইতেছি। সে পথ দিয়া