পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ՕՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী বরিশালে যাইব বলিয়া অনেকে বরিশালে যায় নাই এমন শুনা গিয়াছে ; আমরাও পাছে সেইরূপ ফাঁকি দিই৷ এই সংশয়ে তিনি অনেকক্ষণ ধরিয়া নিজের ডান হাতের পাঁচটা ছােটাে ছােটাে সরু সরু আঙুলের নখের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বিস্তর বিবেচনা করিতে লাগিলেন, অবশেষে ঠিক আটটার সময় নখাণ্ড হইতে যতগুলো বিবেচনা ও যুক্তি সংগ্রহ সম্ভব সমস্ত নিঃশেষে আকর্ষণ করিয়া লইয়া আমাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠিয়া বসিলেন । সকালবেলায় কলিকাতার রাস্তা যে বিশেষ সুদৃশ্য তাঁহা নহে, বিশেষত চিৎপুর রোড। সকালবেলাকার প্রথম সূৰ্যকিরণ পড়িয়াছে শ্যাকরা গাড়ির আস্তাবলের মাথায় আর এক-সার বেলোয়ারি ঝাড়ওয়ালা মুসলমানদের দোকানের উপর। গ্যাসল্যাম্পগুলোর গায়ে সূর্যের আলো এমনি চিকমিক করিতেছে, সে দিকে চাহিবার জো নাই। সমস্ত রাত্রি নক্ষত্রের অভিনয় করিয়া তাহাদের সাধ মেটে নাই, তাই সকালবেলায় লক্ষ যোজন দূর হইতে সূর্যকে মুখ ভেঙাইয়া অতিশয় চকচকে মহত্ত্বলাভের চেষ্টায় আছে। ট্রামগাড়ি শিস দিতে দিতে চলিয়াছে, কিন্তু এখনো যাত্রী বেশি জোটে যাইতেছে। ফুটপাথের পার্থে সারি সারি শ্যাকরা গাড়ি আরোহীর অপেক্ষায় দাড়াইয়া ; সেই অবসরে অশ্বচর্মবৃত চতুষ্পদ কঙ্কালগুলো ঘাড় হেঁট করিয়া অত্যন্ত শুকনো ঘাসের আঁটি অন্যমনস্কভাবে চিবাইতেছে ; তাহদের সেই পারমার্থিক ভাব দেখিলে মনে হয় যে, অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া তাহারা তাহাদের সম্মুখস্থ ঘাসের আঁটির সঙ্গে সমস্ত জগৎসংসারের তুলনা করিয়া সারবত্তা ও সরসতা সম্বন্ধে কোনো প্ৰভেদ দেখিতে পায় নাই। দক্ষিণে মুসলমানের দোকানের হৃতচর্ম খাসির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কতক দড়িতে বুলিতেছে, কতক খণ্ড খণ্ড আকারে শলাকা আশ্রয় করিয়া অগ্নিশিখার উপরে ঘুর খাইতেছে এবং বৃহৎকায় রক্তবর্ণ কেশবিহীন শ্মশ্রুলগণ বড়ো বড়ো হাতে মস্ত মস্ত রুটি সেঁকিয়া তুলিতেছে। কাবাবের দোকানের পাশে ফুকো ফানুষ-নির্মাণের জায়গা, অনেক ভোর হইতেই তাঁহাদের চুলায় আগুন জ্বালানো হইয়াছে। ঝাপ খুলিয়া কেহ বা হাত-মুখ ধুইতেছে, কেহ বা দোকানের সম্মুখে বঁটি দিতেছে, দৈবাৎ কেহ-বা লাল-কলাপ-দেওয়া দাড়ি লইয়া চোখে চশমা আঁটিয়া একখানা পার্সি কেতাব পড়িতেছে। সম্মুখে মসজিদ ; একজন অন্ধ ভিক্ষুক মসজিদের সিঁড়ির উপরে হাত পাতিয়া দাড়াইয়া আছে । গঙ্গার ধারে কয়লাঘাটে গিয়া পৌঁছানো গেল। সম্মুখ হইতে ছাউনিওয়ালা বাধা নীেকাগুলো দৈত্যদের পায়ের মাপে বড়ো বড়ো চটিজুতার মতো দেখাইতেছে। মনে হইতেছে, তাহারা যেন হঠাৎ প্ৰাণ পাইয়া অনুপস্থিত চরণগুলি স্মরণ করিয়া চট্ট চট্ৰ করিয়া চলিবার প্রতীক্ষায় অধীর হইয়া পড়িয়াছে। একবার চলিতে পাইলে হয়, এইরূপ তাহদের ভাব। একবার উঠিতেছে, যেন উচু হইয়া ডাঙার দিকে চাহিয়া দেখিতেছে কেহ আসিতেছে কি না, আবার নামিয়া পড়িতেছে। একবার আগ্রহে অধীর হইয়া জলের দিকে চলিয়া যাইতেছে, আবার কী মনে করিয়া আত্মসংবরণপূর্বক তীরের দিকে ফিরিয়া আসিতেছে। গাড়ি হইতে মাটিতে পা দিতে-না-দিতে বঁাকে বঁাকে মাঝি আমাদের উপরে আসিয়া পড়িল । এ বলে “আমার নীেকায়, ও বলে “আমার নীেকায় । এইরূপে মাঝির তরঙ্গে আমাদের তনুর তরী একবার দক্ষিণে, একবার বামে, একবার মাঝখানে আবর্তের মধ্যে ঘূর্ণিত হইতে লাগিল। অবশেষে অবস্থার তোড়ে, পূর্বজন্মের বিশেষ একটা কী কর্মফলে বিশেষ একটা নীেকার মধ্যে গিয়া পড়িলাম। পাল তুলিয়া নীেকা ছাড়িয়া দিল। গঙ্গায় আজ কিছু বেশি ঢেউ দিয়াছে, বাতাসও উঠিয়াছে। এখন জোয়ার। ছােটাে ছােটাে নীেকাগুলি আজ পাল ফুলাইয়া ভারি তেজে চলিয়াছে; আপনার দেমাকে আপনি কান্ত হইয়া পড়ে না। একটা মস্ত স্টীমার দুই পাশে দুই লীেহতরী লইয়া আশপাশের ছােটােখাটাে নীেকাগুলির প্রতি নিতান্ত অবজ্ঞাভরে লোহার নাকটা আকাশে তুলিয়া গা গা শব্দ করিতে করিতে সধুমনিশ্বাসে আমাদের দিকে ছুটিয়া আসিতেছে। মনােযোগ দিয়া দেখি আমাদেরই জাহাজ— রাখা রাখা! থাম থাম!” মাঝি কহিল, “মহাশয়, ভয় করবেন না, এমন ঢের-বার জাহাজ ধরিয়াছি।’ বলা বাহুল্য। এবারও ধরিল । জাহাজের উপর হইতে একটা সিঁড়ি