পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

aOV。 রবীন্দ্র-রচনাবলী বেগে আমাদের সকলেরই হৃদয় তোলপাড় করিতে লাগিল। চাহিয়া দেখি সম্মুখে আমাদের জাহাজের উপর সবেগে একটা লোহার বয়া ছুটিয়া আসিতেছে, অর্থাৎ আমরা বয়ার উপরে ছুটিয়া চলিতেছি। কিছুতেই সামলাইতে পারিতেছি না। সকলেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো বয়াটার দিকে চাহিয়া আছি। সে জিনিসটা মহিষের মতো টু উদ্যত করিয়া আসিতেছে। অবশেষে ঘা মারিল। O কোথায় সেই অবিশ্রাম জলকল্লোল, শত লক্ষ তরঙ্গের অহােরাত্র উৎসব, কোথায় সেই অবিরল বনশ্রেণী, আকাশের সেই অবারিত নীলিমা, ধরণীর নবযৌবনে পরিপূর্ণ হৃদয়োচ্ছাসের ন্যায় সেই অনন্তের দিকে চির-উচ্ছসিত বিচিত্র তরুতরঙ্গ, কোথায় সেই প্রকৃতির শ্যামল স্নেহের মধ্যে প্রচ্ছন্ন শিশু লোকালয়গুলি- উর্ধের্ব সেই চিরস্থির আকাশের নিম্নে সেই চিরাচঞ্চলা স্রোতস্বিনী ! চিরস্তব্ধের সহিত অবিচ্ছেদ প্রেমের মিলন কোথায়! এখানে সুরকিতে ইটােতে, ধূলিতে নাসারান্ধে, গাড়িতে ঘোড়াতে হঠযোগ চলিতেছে। এখানে চারি দিকে দেয়ালের সহিত দেয়ালের, দরজার সহিত হুড়কার, কড়ির সহিত বরগীর, চাপিকানের সহিত বোতামের আঁটা-আঁটি মিলন । পাঠকেরা বোধ করি বুঝিতে পারিয়াছেন, এতদিন সরেজমিনে লেখা চলিতেছিল- সরে-জমিনে না হউক সরে-জলে বটে— এখন আমরা ডাঙার ধন ডাঙায় ফিরিয়া আসিয়াছি। এখন সেখানকার কথা এখানে, পূর্বেকার কথা পরে লিখিতে হইতেছে, সুতরাং এখন যাহা লিখিব তাহার তুলচুকের জন্য দায়ী হইতে পারিব না । এখন মধ্যাহ্ন। আমার সমুখে একটা ডেস্ক, পাপোশে একটা কালো মোটা কুকুর ঘুমাইতেছে, বারান্দায় শিকলি-বাধা একটা বীদের লেজের উকুন বাছিতেছে, তিনটি কাক আলিসার উপরে বসিয়া অকারণ চেচাইতেছে এবং এক-একবার খপ করিয়া বাদরের ভুক্তাবিশিষ্ট ভাত এক চঞ্চ লইয়া ছাদের উপরে উড়িয়া বসিতেছে। ঘরের কোণে একটা প্রাচীন হারমেনিয়ম-বাদ্যের মধ্যে গোটাকতক ইদুর খটু খট করিতেছে। কলিকাতা শহরের ইমারতের একটি শুষ্ক কঠিন কামরা, ইহারই মধ্যে আমি গঙ্গার আবাহন করিতেছি- তপঃক্ষীিণ জকুমুনির শুষ্ক পাকস্থলীর অপেক্ষা এখানে ঢের বেশি স্থান আছে। আর, স্থানসংকীর্ণতা বলিয়া কোনো পদার্থ প্রকৃতির মধ্যে নাই। সে আমাদের মনে। দেখে- বীজের মধ্যে অরণ্য, একটি জীবের মধ্যে তাহার অনন্ত বংশপরম্পরা। আমি যে ঐ স্টফেন সাহেবের এক বোতল ব্ল-ব্ল্যাক কালি কিনিয়া আনিয়াছি, উহারই প্রত্যেক ফোটার মধ্যে কত পাঠকের সুষুপ্তি মাদার-টিংচার-আকারে বিরাজ করিতেছে। এই কালির বোতল দৈবক্রমে যদি সুযোগ্য হাতে পড়িত তবে ওটাকে দেখিলে ভাবিতম, সৃষ্টির পূর্ববর্তী অন্ধকারের মধ্যে এই বিচিত্র আলোকময় অমর জগৎ যেমন প্রচ্ছন্ন ছিল তেমনি ঐ এক বোতল অন্ধকারের মধ্যে কত আলোকময় নূতন সৃষ্টি প্রচ্ছন্ন আছে। একটা বোতল দেখিয়াই এত কথা মনে উঠে, যেখানে স্টীফেন সাহেবের কালির কারখানা সেখানে দাঁড়াইয়া একবার ভাবিলে বােধ করি মাথা ঠিক রাখিতে পারি না। কত পুঁথি, কত চটি, কত যশ, কত কলঙ্ক, কত জ্ঞান, কত পাগলামি, কত ফাঁসির হুকুম, যুদ্ধের ঘোষণা, প্রেমের লিপিকালো কালো হইয়া স্রোত বাহিয়া বাহির হইতেছে। ঐ স্রোত যখন সমস্ত জগতের উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে- তখনদূর হউক। কালি যে ক্রমেই গড়াইতে চলিল, স্টফেন সাহেবের সমস্ত কারখানাটাই দৈবাৎ যেন উলটাইয়া পড়িয়ছে- এবার ব্লটিং কাগজের কথা মনে পড়িতেছে। স্রোত ফিরানো যাক | এসো, KK KI GANS GP | সত্য ঘটনায় ও উপন্যাসে প্রভেদ আছে তাহার সাক্ষ্য দেখো, আমাদের জাহাজ বয়ায় ঠেকিল, তবু ডুবিল না— পরমবীরত্ব-সহকারে কাহাকেও উদ্ধার করিতে হইল না— প্রথম পরিচ্ছেদে জলে ডুবিয়া মরিয়া ষড়বিংশ পরিচ্ছেদে কেহ ডাঙায় বীচিয়া উঠিল না। না ডুবিয়া সুখী হইয়াছি সন্দেহ নাই, কিন্তু