পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রাচীন সাহিত্য Գ ՏՏ নিঃশেষ করিয়া দেন নাই। তিনি যেমন ইহার হঠাৎ জয়সংবাদ আনিয়াছেন তেমনি অন্য দুৰ্জয় শক্তি-দ্বারা পূর্ণতর চরম মিলন ঘটাইয়া। তবে কাব্য বন্ধ করিয়াছেন। স্বর্গের দেবরাজের দ্বারা উৎসারিত এবং বসন্তের মোহিনী শক্তির দ্বারা সহায়বান, মদনকে কেবলমাত্র পরাস্ত করিয়া ছাড়েন নাই, তাহার স্থলে যাহাকে জয়ী করিয়াছেন তাহার সজ্জা নাই, সহায় নাই, তাহা তপস্যায় কৃশ, দুঃখে মলিন। স্বর্গের দেবরাজ তাহার কথা চিন্তাও করেন নাই | যে প্রেমের কোনাে বন্ধন নাই, কোনাে নিয়ম নাই, যাহা অকস্মাৎ নরনারীকে অভিভূত করিয়া সংযমদূর্গের ভগ্নপ্রাকারের উপর আপনার জয়ধ্বজা নিখাত করে, কালিদাস তাহার শক্তি স্বীকার করিয়াছেন, কিন্তু তাহার কাছে আত্মসমৰ্পণ করেন নাই। তিনি দেখাইয়াছেন, যে অন্ধ প্রেমসম্ভোগ আমাদিগকে স্বাধিকারপ্ৰমত্ত করে তাহা ভর্তুশাপের দ্বারা খণ্ডিত, ঋষিশাপের দ্বারা প্রতিহত ও দেবরোষের দ্বারা ভস্মসাৎ হইয়া থাকে। শকুন্তলার কাছে যখন আতিথ্যধর্ম কিছুই নহে, দুষ্মন্তই সমস্ত, তখন শকুন্তলার সে প্রেমে আর কল্যাণ রহিল না । যে উন্মত্ত প্ৰেম প্ৰিয়জনকে ছাড়া আর-সমস্তই বিস্তৃত হয় তাহা সমস্ত বিশ্বনীতিকে আপনার প্রতিকূল করিয়া তোলে, সেইজন্যই সে প্ৰেম অল্প দিনের মধ্যেই দুর্ভর হইয়া উঠে, সকলের বিরুদ্ধে আপনাকে আপনি সে আর বহন করিয়া উঠিতে পারে না । যে আত্মসংবৃত প্রেম সমস্ত সংসারের অনুকুল, যাহা আপনার চারিদিকের ছােটাে এবং বড়ো, আত্মীয় এবং পর, কাহাকেও ভোলে না, যাহা প্ৰিয়জনকে কেন্দ্ৰস্থলে রাখিয়া বিশ্বপরিধির মধ্যে নিজের মঙ্গলমধুর্য বিকীর্ণ করে, তাহার ধ্রুবত্বে দেবে মানবে কেহ আঘাত করে না, আঘাত করিলেও সে তাহাতে বিচলিত হয় না। কিন্তু যাহা যতির তপোবনে তপোভঙ্গরূপে, গৃহীর গৃহ-প্রাঙ্গণে সংসারধর্মের অকস্মাৎ পরাভবম্বরূপে আবির্ভূত হয়, তাহা ঝঙ্কার মতো অন্যকে নষ্ট করে বটে, কিন্তু নিজের বিনাশকেও নিজেই বহন করিয়া আনে । পর্যাপ্তযৌবনপুঞ্জে অবনমিতা উমা সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতার ন্যায় আসিয়া গিরিশের পদপ্রান্তে লুষ্ঠিত হইয়া প্ৰণাম করিলেন, তাহার কর্ণ হইতে পল্লব এবং অলক হইতে নবকণিকার বিচুত হইয়া পড়িয়া গেল। মন্দাকিনীর জলে যে পদ্ম ফুটিত, সেই পদ্মের বীজ রৌদ্রকিরণে শুষ্ক করিয়া নিজের হাতে গৌরী যে জপমালা গাথিয়ছিলেন সেই মালা। তিনি তাহার তাম্ররুচি করে সন্ন্যাসীর হস্তে সমর্পণ করিলেন । হাতে হাতে ঠেকিয়া গেল। বিচলিতচিত্ত যোগী একবার উমার মুখে, উমার বিম্বাধরে র্তাহার তিন নেত্রকেই ব্যাপৃত করিয়া দিলেন। উমার শবীর তখন পুলককুল, দুই চক্ষু লজ্জায় পর্যন্ত এবং মুখ এক দিকে সাচীকৃত। কিন্তু অপূর্ব সৌন্দর্যে অকস্মাৎ উদভাসমান এই-যে হর্ষ দেবতা ইহাকে বিশ্বাস করিলেন না, সরোষে ইহাকে প্রত্যাখ্যান করিলেন। নিজের ললিতযৌবনের সৌন্দর্য অপমানিত হইল জানিয়া লজ্জাকুষ্ঠিতা রমণী কোনোমতে গৃহে ফিরিয়া গেলেন । কশ্বন্দুহিতাকেও একদিন তাহার যৌবনলাবণ্যের সমস্ত ঐশ্বৰ্যসম্পদ লইয়া অপমানিত হইয়া ফিরিতে হইয়াছিল। দুর্বাসার শাপ কবির রূপকমাত্র। দুষ্মন্ত-শকুন্তলার বন্ধনহীন গোপন মিলন চিরকালের অভিশাপে অভিশপ্ত । উন্মত্ততার উজ্জ্বল উন্মেষ ক্ষণকালের জন্যই হয় ; তাহার পরে অবসাদের, অপমানের, বিস্মৃতির অন্ধকার আসিয়া আক্রমণ করে। ইহা চিরকালের বিধান। কালে কালে দেশে দেশে অপমানিত নারী ‘ব্যৰ্থং সমর্থ্য ললিতং বপুরাত্মনশ্চ’ আপনার ললিত দেহকান্তিকে ব্যর্থ জ্ঞান করিয়া, শূন্য জগাম ভবনাভিমুখী কথঞ্চিৎ শূন্যহৃদয়ে কোনােক্রমে গৃহের দিকে ফিরিয়াছে। ললিত দেহের সৌন্দর্যই নারীর পরম গৌরব, চরম সৌন্দর্য নহে । সেইজন্যই ‘নিনিন্দ রূপং হৃদয়েন পার্বতী’, পার্বতী রূপকে মনে মনে নিন্দা করিলেন । এবং ইয়েষ সা কর্তৃমবন্ধ্যরূপতাম, তিনি আপনার রূপকে সফল করিতে ইচ্ছা করিলেন। রূপকে সফল করিতে হয় কী করিয়া ? সাজে সজায় বসনে অলংকারে ? সে পরীক্ষা তো ব্যর্থ হইয়া গেছে।-- ইয়েষ সা কর্তৃমবন্ধ্যরূপতাং সমাধিমাস্থায় তপোভিরাত্মনঃ।