পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৭৩২ -- রবীন্দ্র-রচনাবলী দ্বারা, সেই স্বৰ্গ যখন জিত হইল। তখন আর কোনো শঙ্কা রহিল না । এ স্বৰ্গ শাশ্বত । মানুষের জীবন এইরূপ— শিশু যে সরল স্বর্গে থাকে তাহা সুন্দর, তাহা সম্পূর্ণ, কিন্তু ক্ষুদ্র। মধ্যবয়সের সমস্ত বিক্ষেপ ও বিক্ষোভ, সমস্ত অপরাধের আঘাত ও অনুতাপের দাহ, জীবনের পূৰ্ণবিকাশের পক্ষে আবশ্যক। শিশুকালের শান্তির মধ্য হইতে বাহির হইয়া সংসারের বিরোধবিপ্লবের মধ্যে না পড়িলে পরিণত বয়সের পরিপূর্ণ শান্তির আশা বৃথা। প্ৰভাতের স্নিগ্ধতাকে মধ্যাহ্নতাপে দগ্ধ করিয়া। তবেই সায়াহ্নের লোকলোকান্তরব্যাপী বিরাম। পাপে-অপরাধে ক্ষণভঙ্গুরকে ভাঙিয়া দেয় এবং অনুতাপ-বেদনায় চিরস্থায়ীকে গড়িয়া তোলে। শকুন্তলা-কাব্যে কবি সেই স্বৰ্গচূতি হইতে স্বৰ্গপ্রাপ্তি পর্যন্ত সমস্ত বিবৃত করিয়াছেন। অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকখানির মধ্যে আমরা তাহার প্রতিরূপ দেখিতে পাই। এমন আশ্চর্য সংযম আমরা আর-কোনো নাটকেই দেখি নাই। প্রবৃত্তির প্রবলতাপ্রকাশের অবসরমাত্ৰ পাইলেই য়ুরোপীয় কবিগণ যেন উদ্দাম হইয়া উঠেন। প্রবৃত্তি যে কতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে তাহা অতিশয়ৌক্তিদ্বারা ভূরি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। শকুন্তলার মতো এমন প্রশান্ত-গভীর, এমন সংযত-সম্পূর্ণ নাটক শেকসপীিয়রের নাট্যাবলীর মধ্যে একখানিও নাই। দুষ্মন্ত-শকুন্তলার মধ্যে যেটুকু প্রেমালাপ আছে, তাহা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, তাহার অধিকাংশই আভাসে ইঙ্গিতে ব্যক্ত হইয়াছে, কালিদাস কোথাও রাশ আলগা করিয়া দেন নাই। অন্য কবি যেখানে লেখনীকে দৌড় দিবার অবসর অন্বেষণ করিত তিনি সেখানেই তাহাকে হঠাৎ নিরস্ত করিয়াছেন । দুষ্মন্ত তপোবন হইতে রাজধানীতে ফিরিয়া গিয়া শকুন্তলার কোনো খোজ লইতেছেন না। এই উপলক্ষে বিলাপ-পরিতাপের কথা অনেক হইতে পারিত, তবু শকুন্তলার মুখে কবি একটি কথাও দেন নাই। কেবল দুর্বাসার প্রতি আতিথ্যে অনবধান লক্ষ্য করিয়া হতভাগিনীর অবস্থা আমরা যথাসম্ভব কল্পনা করিতে পারি। শকুন্তলার প্রতি কন্ধের একান্ত মেহ বিদায়কালে কী সকরুণ গাম্ভীর্য ও সংযমের সহিত কত অল্প কথাতেই ব্যক্ত হইয়াছে। অনসূয়া-প্রিয়ংবদার সখীবিচ্ছেদবেদনা ক্ষণে ক্ষণে দুটি-একটি কথায় যেন বঁাধ লঙ্ঘন করিবার চেষ্টা করিয়া তখনি আবার অন্তরের মধ্যে নিরস্ত হইয়া যাইতেছে। প্রত্যাখ্যানদৃশ্যে ভয়, লজ্জা, অভিমান, অনুনয়, ভৎসনা, বিলাপ, সমস্তই আছে, অথচ কত অল্পের মধ্যে। যে শকুন্তলা সুখের সময় সরল অসংশয়ে আপনাকে বিসর্জন দিয়াছিল, দুঃখের সময় দারুণ অপমানকালে সে যে আপন হৃদয়বৃত্তির অপ্ৰগলভ মর্যাদা এমন আশ্চর্য সংযমের সহিত রক্ষা করিবে, এ কে মনে করিয়াছিল ? এই প্রত্যাখ্যানের পরবতী নীরবতা কী ব্যাপক, কী গভীর ! কথু নীরব, অনসূয়া-প্রিয়ংবদা নীরব, মালিনীতীরতপোবন নীরব, সর্বাপেক্ষা নীরব শকুন্তলা । হৃদয়বৃত্তিকে আলোড়ন করিয়া তুলিবার এমন অবসর কি আর-কোনো নাটকে এমন নিঃশব্দে উপেক্ষিত হইয়াছে ? দুষ্মন্তের অপরাধকে দুর্বাসার শাপের আচ্ছাদনে আবৃত করিয়া রাখা, সেও কবির সংযম | দুষ্টপ্রবৃত্তির দুরন্তপনাকে অবারিতভাবে উদ্ধৃঙ্খলভাবে দেখাইবার যে প্রলোভন তাহাও কবি সংবরণ করিয়াছেন। র্তাহার কাব্যলক্ষ্মী নিষেধ করিয়া বলিয়াছেন— ন খলু ন খলু বাণঃ সন্নিপাত্যোহয়৷মস্মিন মৃদুনি মৃগশরীরে পুষ্পরাশবিবাগ্নিঃ । দুষ্মন্ত যখন কাব্যের মধ্যে বিপুল বিক্ষোভের কারণ লইয়া মত্ত হইয়া প্রবেশ করিলেন তখন কবির অন্তরের মধ্যে এই ধ্বনি উঠিল-- মুর্তে বিদ্যুস্তপস ইব নাে ভিন্নসারঙ্গযুথো ধর্মরণ্যং প্রবিশন্তি গজঃ সান্দনালোকভীতঃ । তপস্যার মূর্তিমান বিয়ের ন্যায় গজরাজ ধৰ্মরণ্যে প্রবেশ করিয়াছে। এইবার বুঝি কাব্যের শান্তিভঙ্গ হয়। কালিদাস তখনই ধৰ্মরণ্যের, কাব্যাকাননের, এই মূর্তিমান বিমুকে শাপের বন্ধনে সংযত