পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ᏄᏬ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ইতিহাস-উপন্যাস থাকে, তাহার মধ্যে আগ্রহ নাই। বর্ণনা তত্ত্বালোচনা ও অবান্তর প্রসঙ্গে তাহার গল্পপ্রবাহ পদে পদে খণ্ডিত হইলেও প্রশান্ত ভারতবর্ষের ধৈর্যচ্যুতি দেখা যায় না। এগুলি মূল কাব্যের অঙ্গ, না প্রক্ষিপ্ত সে আলোচনা নিস্ফল ; কারণ, প্ৰক্ষেপ সহ্য করিবার লোক না থাকিলে প্রক্ষিপ্ত টিকিতে পারে না। পর্বতশৃঙ্গ হইতে নদী যদি বা শৈবাল বহন করিয়া না আনে, তথাপি তাহার স্রোত ক্ষীণবেগ হইলে তাহার মধ্যে শৈবাল জন্মিবার অবসর পায় । ভগবদগীতার মাহাত্ম্য কেহ অস্বীকার করিতে পরিবে না, কিন্তু যখন কুরুক্ষেত্রের তুমুল যুদ্ধ আসন্ন তখন সমস্ত ভগবদগীতা অবহিত হইয়া শ্ৰবণ করিতে পারে, ভারতবর্ষ ছাড়া এমন দেশ জগতে আর নাই। কিষ্কিন্ধ্যা এবং সুন্দর-কাণ্ডে সৌন্দর্যের অভাব নাই এ কথা মানি, তবু রাক্ষস যখন সীতাকে হরণ করিয়া লইয়া গেল তখন গল্পের উপর অত বড়ো একটা জগদ্দল পাথর চাপাইয়া দিলে সহিষ্ণু ভারতবৰ্ষই কেবল তাহা মার্জনা করিতে পারে । কেনই বা সে মার্জনা করে ? কারণ, গল্পের শেষ শুনিবার জন্য তাহার কিছুমাত্র সত্বরতা নাই | প্ৰকাণ্ড কাণ্ড এবং আঠারোটি বিপুলায়তন পর্ব অকাতরচিত্তে মৃদুমন্দগতিতে পরিভ্রমণ করিতে কিছুমাত্র ক্লান্তি বোধ করে না । আবার, গল্প শুনিবার আগ্রহ-অনুসারে গল্পের প্রকৃতিও ভিন্নরূপ হইয়া থাকে। ছয়টি কাণ্ডে যে গল্পটিবেদনা ও আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, একটিমাত্র উত্তরকাণ্ডে তাহাকে অসংকোচচূর্ণ করিয়া ফেলা কি সহজ ব্যাপার ? আমরা লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত এই দেখিয়া আসিলাম যে, অধৰ্মচারী নিষ্ঠুর রাক্ষস রাবণই সীতার পরম শত্ৰু, অসাধারণ শৌর্যে ও বিপুল আয়োজনে সেই ভয়ংকর রাবণের হাত হইতে সীতা যখন পরিত্রাণ পাইলেন তখন আমাদের সমস্ত চিন্তা দূর হইল, আমরা আনন্দের জন্য প্রস্তুত হইলাম, এমন সময় মুহুর্তের মধ্যে কবি দেখাইয়া দিলেন— সীতার চরম শত্রু অধাৰ্মিক রাবণ নহে, সে শত্রু ধর্মনিষ্ঠ রাম ; নির্বাসনে তাহার তেমন সংকট ঘটে নাই, যেমন র্তাহার রাজাধিরাজ স্বামীর গৃহে । যে সোনার তরণী দীর্ঘকাল যুঝিয়া ঝড়ের হাত হইতে উদ্ধার পাইল, ঘাটের পাষণে ঠেকিবামাত্র এক মুহূর্তে তাহা দুইখানা হইয়া গেল। গল্পের উপর যাহার কিছুমাত্র মমতা আছে, সে কি এমন আকস্মিক উপদ্রব সহ্য করিতে পারে ? যে বৈরাগ্য-প্রভাবে আমরা গল্পের নানাবিধ প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক বাধা সহ্য করিয়াছি, সেই বৈরাগ্যই গল্পটির অকস্মাৎ অপঘাতমূতৃত্যুতে আমাদের ধৈর্য রক্ষা করিয়া থাকে। মহাভারতেও তাই। এক স্বৰ্গারোহণপর্বেই কুরুক্ষেত্ৰ-যুদ্ধটার স্বৰ্গপ্রাপ্তি হইল। গল্পপ্রিয় ব্যক্তির কাছে গল্পের অবসান যেখানে মহাভারত সেখানে থামিলেন, না— অতবড়ো গল্পটাকে বালুনির্মিত খেলাঘরের মতাে এক মুহূর্তে ভাঙিয়া দিয়া চলিয়া গেলেন ; সংসারের প্রতি এবং গল্পের প্রতি যাহাদের বৈরাগ্য তাহারা ইহার মধ্য হইতে সত্য লাভ করিল এবং ক্ষুব্ধ হইল না । মহাভারতকে যে লোক গল্পের মতো করিয়া পড়িতে চেষ্টা করে সে মনে করে অর্জুনের শৌর্য অমোঘ, সে মনে করে শ্লোকের উপর শ্লোক গাথিয়া মহাভারতকার অর্জনের জয়স্তম্ভ। অভ্ৰভেদী করিয়া তুলিতেছেন— কিন্তু সমস্ত কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের পর হঠাৎ একদিন এক স্থানে অতি অল্প কথার মধ্যে দেখা গেল, একদল সামান্য দসু্যু কৃষ্ণের রমণীদিগকে অর্জুনের হাত হইতে কড়িয়া লইয়া গেল, নারীগণ কৃষ্ণসখা পার্থকে আহবান করিয়া আর্তম্বরে বিলাপ করিতে লাগিলেন, অর্জন গাণ্ডীব তুলিতে পারিলেন না। অর্জনের এমন অভাবনীয় অবমাননা যে মহাভারতকারের কল্পনায় স্থান পাইতে পারে তাহা পূর্ববর্তী অতগুলা পর্বের মধ্যে কেহ সন্দেহ করিতে পারে নাই। কিন্তু কাহারও উপর কবির মমতা নাই। যেখানে শ্রোতা বৈরাগী, লৌকিক শৌর্য বীর্য মহত্ত্বের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম স্মরণ করিয়া অনাসক্ত, সেখানে কবিও নির্মম এবং কাহিনীও কেবলমাত্র কৌতুহল চরিতার্থ করিবার জন্য সর্বপ্রকার ভার মোচন করিয়া দ্রুতবেগ অবলম্বন করে না । তাহার পর মাঝখানে সুদীর্ঘ বিচ্ছেদ পাের হইয়া কাব্যসাহিত্যে একেবারে কালিদাসে আসিয়া ঠেকিতে হয়। ইতিপূর্বে ভারতবর্ষ চিত্তরঞ্জনের জন্য কী উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি না। উৎসবে যে মাটির প্রদীপের সুন্দর দীপমালা রচনা হয়। পরদিন তাহা কেহ