পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রাচীন সাহিত্য ዒw©(ሱ তুলিয়া রাখে না ; ভারতবর্ষে আনন্দ-উৎসবে নিশ্চয়ই এমন অনেক মাটির প্রদীপ, অনেক ক্ষণিক সাহিত্য, নিশীথে আপন কর্মসমাপন করিয়া প্ৰত্যুষে বিস্মৃতিলোক লাভ করিয়াছে। কিন্তু প্ৰথম তৈজস প্ৰদীপ দেখিলাম কালিদাসের ; সেই পৈতৃক প্ৰদীপ এখনো আমাদের ঘরে রহিয়া গেছে ; আমাদের উজ্জয়িনীবাসী পিতামহের প্রাসাদশিখরে তাহা প্রথম জুলিয়াছিল, এখনো তাহাতে কলঙ্ক পড়ে নাই। কেবল আনন্দদানকে উদ্দেশ্য করিয়া কাব্যরচনা সংস্কৃতসাহিত্যে কেবল কালিদাসে প্রথম দেখা গেল। ( এখানে আমি খণ্ডকাব্যের কথা বলিতেছি, নাটকের কথা নহে। ) মেঘদূত তাহার এক দৃষ্টান্ত। এমন দৃষ্টান্ত সংস্কৃতসাহিত্যে বােধ করি আর নাই। যাহা আছে তাহা মেঘদূতেরই আধুনিক অনুকরণ, যথা পদাঙ্কদূত প্রভৃতি, এবং তাহাও পৌরাণিক। কুমারসম্ভব রঘুবংশ পৌরাণিক বটে, কিন্তু তাহা পুরাণ নহে, কাব্য ; তাহা চিত্তবিনোদনের জন্য লিখিত, তাহার পাঠফলে স্বৰ্গপ্ৰাপ্তির প্রলোভন নাই। ভারতবষীয় আৰ্যসাহিত্যের ধর্মপ্ৰাণতা সম্বন্ধে যিনি যেমন মতবাদ প্রচার করুন, আশা করি, ঋতুসংহার-পাঠে মোক্ষলাভের সহায়তা হইবে এমন উপদেশ কেহ দিবেন না। কিন্তু তথাপি কালিদাসের কুমারসম্ভবে গল্প নাই ; যেটুকু আছে সে সূত্রটি অতি সূক্ষ্ম এবং প্রচ্ছন্ন, এবং তাহাও অসমাপ্ত। দেবতারা দৈত্যহস্ত হইতে কোনো উপায়ে পরিত্রাণ পাইলেন কি না-পাইলেন সে সম্বন্ধে কবির কিছুমাত্র ঔৎসুক্য দেখিতে পাই না ; তঁহাকে তাড়া দিবার লোকও কেহ নাই। অথচ বিক্ৰমাদিত্যের সময় শকতুন-রূপী শত্রুদের সঙ্গে ভারতবর্ষের খুব একটা দ্বন্দ্ব চলিতেছিল এবং স্বয়ং বিক্ৰমাদিত্য তাহার একজন নায়ক ছিলেন ; অতএব দেবদৈত্যের যুদ্ধ এবং স্বর্গের পুনরুদ্ধারপ্রসঙ্গ তখনকার শ্রোতাদের নিকট বিশেষ ঔৎসুক্যজনক হইবে এমন আশা করা যায়। কিন্তু কই ? রাজসভার শ্রোতারা দেবতাদের বিপৎপাতে উদাসীন । মদনভস্ম, রতিবিলাপ, উমার তপস্যা, কোনোটাতেই ত্বরান্বিত হইবার জন্য কোনো উপরোধ দেখি না। সকলেই যেন বলিতেছেন, গল্প থাক, এখন ঐ বর্ণনাটাই চলুক। রঘুবংশও বিচিত্র বর্ণনার উপলক্ষমাত্র । রাজশ্রোতারা যদি গল্পলোলুপ হইতেন তবে কালিদাসের লেখনী হইতে তখনকার কালের কতকগুলি চিত্র পাওয়া যাইত। হায়, অবন্তীরাজ্যে নববর্ষার দিনে উদয়ন-কথাকোবিদ গ্রামবুদ্ধেরা যে গল্প করিতেন সে-সমস্ত গেল কোথায় ? আসল কথা, গ্রামবৃদ্ধেরা তখন গল্প করিতেন, কিন্তু সে গ্রামের ভাষায় । সে ভাষায় যে কবিরা রচনা করিয়াছেন তাহারা যথেষ্ট আনন্দদান করিয়াছেন, কিন্তু তাহার পরিবর্তে অমরতা লাভ করেন নাই। তঁহাদের কবিত্ব অল্প ছিল বলিয়া যে র্তাহারা বিনাশ পাইয়াছেন এমন কথা বলি না । নিঃসন্দেহ তাহাদের মধ্যে অনেক মহাকবি জন্মিয়াছিলেন । কিন্তু গ্ৰাম্যভাষা প্রদেশবিশেষে বদ্ধ, শিক্ষিতমণ্ডলীকর্তৃক উপেক্ষিত এবং কালে কালে তাহা পরিবর্তিত হইয়া আসিয়াছে- সে ভাষায় র্যাহারা রচনা করিয়াছেন তাহারা কোনো স্থায়ী ভিত্তি পান নাই। নিঃসন্দেত অনেক বড়ো বড়ো সাহিত্যপুরী চলনশীল পলিমৃত্তিকার মধ্যে নিহিত হইয়া একেবারে অদৃশ্য হইয়া (ள8 সংস্কৃত ভাষা কথ্য ভাষা ছিল না বলিয়াই সে ভাষায় ভারতবর্ষের সমস্ত হৃদয়ের কথা সম্পূৰ্ণ করিয়া বলা হয় নাই। ইংরাজি অলংকারে যে শ্রেণীর কবিতাকে লিরিকস বলে তাহা মৃত ভাষায় সম্ভাবে না। কালিদাসের বিক্রমোর্কশীতে যে সংস্কৃত গান আছে তাহাতেও গানের লঘত ও সরলতা ও অনির্বচনীয় মাধুর্যটুকু পাওয়া যায় না। বাঙালি জয়দেব সংস্কৃত ভাষাতে গান রচনা করিতে পারিয়াছেন, কিন্তু বাঙালি বৈষ্ণব কবিদের বাংলা পদাবলীর সহিত তাহার তুলনা হয় না। মৃত ভাষায়, পরের ভাষায় গল্পও চলে না। কারণ, গল্পে লঘুতা এবং গতিবেগ আবশ্যক- ভাষা যখন ভাসাইয়া লইয়া যায় না, ভাষাকে যখন ভারের মতো বহন করিয়া চলিতে হয়, তখন তাহাতে গান এবং গল্প সম্ভব হয় না । - - কালিদাসের কাব্য ঠিক স্রোতের মতো সর্বাঙ্গ দিয়া চলে না ; তাহার প্রত্যেক শ্লোক আপনাতে আপনি সমাপ্ত, একবার থামিয়া দাড়াইয়৷ সেই শ্লোকটিকে আয়ত্তে করিয়া লইয়া। তবে পরের শ্লোকে হস্তক্ষেপ করিতে হয়। প্রত্যেক শ্লোকটি স্বতন্ত্র হীরকখণ্ডের ন্যায় উজ্জ্বল এবং সমস্ত কাব্যটি