পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রাচীন সাহিত্য ዓw9ዓ আমাদিগকে কথাসংক্ষেপের সমুদয় কৌশল শিক্ষা করিতে হয়। তখনকার কালের মনোরঞ্জনের জন্য যে বিদ্যার প্রয়োজন ছিল এখনকার কালের মনোরঞ্জনের জন্য ঠিক তাহার উলটা বিদ্যা আবশ্যক হইয়াছে । কিন্তু এক কালের মধুলোভীযদি অন্য কাল হইতে মধুসংগ্ৰহ করিতে ইচ্ছা করেন তবে নিজকালের প্রাঙ্গণের মধ্যে বসিয়া বসিয়া তিনি তাহা পাইবেন না, অন্য কালের মধ্যে র্তাহাকে প্রবেশ করিতে হইবে। কাদম্বরী যিনি উপভোগ করিতে চান তঁহাকে ভুলিতে হইবে যে আপিসের বেলা হইতেছে ; মনে করিতে হইবে যে তিনি বাক্যরসবিলাসী রাজ্যেশ্বরবিশেষ, রাজসভা-মধ্যে সমাসীন এবং ‘সমানবয়োবিদ্যালংকারৈঃ অখিলকিলাকলাপালোচনকঠোরমতিভিঃ অতিপ্ৰগলভৈঃ অগ্রাম্যপরিহাসকুশলৈঃ কাব্যনাটকখানাখ্যায়িকালেখ্যব্যাখ্যানাদিক্রিয়ানিপুণৈঃ বিনয়ব্যবহারিভিঃ আত্মনঃ প্রতিবিম্বৈরিব রাজপুত্ৰৈঃ সহ রমমাণঃ’ | এইরূপ রাসচর্চায় রসিকপরিবৃত হইয়া থাকিলে লোকে প্রতিদিনের সুখদুঃখসমাকুল যুধ্যমান ঘর্মসিক্ত কর্মনিরত সংসার হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। মাতাল যেরূপ আহার ভুলিয়া মদ্যপান করিতে থাকে তাহারাও সেইরূপ জীবনের কঠিন অংশ পরিত্যাগ করিয়া ভাবের তরলরাস-পানে বিহবল হইয়া থাকে ; তখন সত্যের যাথা তথ্য ও পরিমাণের প্রতি দৃষ্টি থাকে না ; কেবল আদেশ হইতে থাকে, ঢালো ঢালো, আরো ঢালো। এখনকার দিনে মনুষ্যের প্রতি আমাদের আকর্ষণ বেশি হইয়াছে ; লোকটা কে এবং সে কী করিতেছে ইহার প্রতি আমাদের অত্যন্ত কৌতুহল। এইজন্য ঘরে বাহিরে চতুর্দিকে মানুষের ক্রিয়াকলাপ জীবনবৃত্তান্ত আমরা তন্ন তন্ন করিয়া পর্যালোচনা করিয়াও পরিতৃপ্ত হই না । কিন্তু সেকালে পণ্ডিতই বল, রাজাই বল, মানুষকে বড়ো বেশি-কিছু মনে করিতেন না। বোধ করি স্মৃতিবিহিত নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াকর্মে এবং একান্ত অবহিতভাবে শাস্ত্ৰাদি-আলোচনায় তাহারা জগৎসংসারে অনেকটা বেশি নির্লিপ্ত ছিলেন । বোধ করি বিধিবিধান-নিয়মসংযমের শাসনে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের বড়ো একটা প্রশ্ৰয় ছিল না। এইজন্য রামায়ণ-মহাভারতের পরবর্তী সংস্কৃত সাহিত্যে লোকচরিত্রসৃষ্টি এবং সংসারবর্ণনার প্রাধান্য দেখা যায় না। ভােব এবং রস তাহার প্রধান অবলম্বন । রঘুর দিগ্বিজয়-ব্যাপারে অনেক উপমা এবং সরস বর্ণনা প্রকাশিত হইয়াছে, কিন্তু রঘুর বীরত্বের বিশেষ একটা চরিত্রগত চিত্র পরিস্ফুট করিবার চেষ্টা দেখা যায় না। অজ-ইন্দুমতী-ব্যাপারে অজ এবং ইন্দুমতী উপলক্ষ মাত্ৰ— তাহাদের ব্যক্তিগত বিশেষ মূর্তি সুস্পষ্ট নহে, কিন্তু পরিণয় প্রণয় ও বিচ্ছেদশোকের একটি সাধারণ ভাব ও রস সেই সর্গে উচ্ছলিত হইতেছে। কুমারসম্ভবে হরপার্বতীকে অবলম্বন করিয়া প্রেম সৌন্দর্য উপমা বর্ণনা তরঙ্গিত হইয়া । উঠিয়াছে। মনুষ্য ও সংসারের বিশেষত্বের প্রতি সেকালের সেই অপেক্ষাকৃত ঔদাসীন্য থাকাতে । ভাষা— বর্ণনা- মনুষ্যকে ও ঘটনাকে সর্বত্র আচ্ছন্ন করিয়া আপন রস বিস্তার করিয়াছে। সেই কথাটি স্মরণ রাখিয়া আধুনিক কালের বিশেষত্ব বিস্মৃত হইয়া কাদম্বরীর রসাস্বাদে প্রবৃত্ত হইলে আনন্দের সীমা থাকিবে না | কল্পনা করিয়া দেখো গায়ক গান গাহিতেছে, "চ-ল-ত-রা-আ-আ-আ-আ, ফিরিয়া পুনরায় 'চ-ল-ত-র আ আ আ সুদীর্ঘ তান— শ্রোতারা সেই তানের খেলায় উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছে। এ দিকে গানের কথায় আছে। 'চলত রাজকুমারী, কিন্তু তানের উপদ্রবে। বেলা বহিয়া যায়, রাজকুমারীর আর চলাই হয় না । সমজদার শ্রোতাকে জিজ্ঞাসা করিলে, সে বলে, রাজকুমারী না চলে তো নাই চলুক, কিন্তু তানটা চলিতে থাক। অবশ্য, রাজকুমারী কোন পথে চলিতেছেন সে সংবাদের জন্য যাহার বিশেষ উদবেগ আছে তাহার পক্ষে তানটা দুঃসহ ; কিন্তু উপস্থিত ক্ষেত্রে যদি রস উপভোগ করিতে চাও, তবে রাজকুমারীর গমস্থান-নির্ণয়ের জন্য নিরতিশয় অধীর না হইয়া তানটা শুনিয়া লও। কারণ, যে জায়গায় আসিয়া পড়িয়াছ। এখানে কৌতুহলে অধীর হইয়া ফল নাই, ইহা রসে মাতোয়ারা হইবার স্থান। অতএব স্নিগ্ধজলদনির্ঘোষে আপাতত শূদ্রক রাজার বর্ণনা শোনা যাক। সে বর্ণনায় আমরা শূদ্রক রাজার চরিত্রচিত্র প্রত্যাশা করিব না । কারণ, চরিত্রচিত্রে একটা সীমারেখা অঙ্কিত করিতে হয়— ইহাতে সীমা নাই— ভাষা কল্লোলামুখর সমুদ্রের বনার নায় যতদূর উদবেল, দুইয়াছে তাহাকে