পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q\Obr রবীন্দ্র-রচনাবলী বাধা দিবার কেহ নাই। যদিও সত্যের অনুরোধে বলিতে হইয়াছে। শূদ্ৰক বিদিশা নগরীর রাজা, তথাপি অপ্ৰতিহতগামিনী ভাষা ও ভাবের অনুরোধে বলিতে হইয়াছে, তিনি চতুরুদধিমালামেখলায়া ভুবাে। ভর্তা । শূদ্রকের মহিমা কতটুকু ছিল সেই ব্যক্তিগত তুচ্ছতথ্যালোচনায় প্রয়োজন নাই, কিন্তু রাজকীয় মহিমা কতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে সেই কথা যথোচিত সমারোহসহকারে ঘোষিত হউক । সকলেই জানেন, ভাব সত্যের মতো কৃপণ নহে। সত্যের নিকট যে ছেলে কানা, ভাবের নিকট তাহার পদ্মলোচন হওয়া কিছুই বিচিত্র নহে। ভাবের সেই রাজকীয় অজস্রতার উপযোগী ভাষা সংস্কৃত ভাষা। সেই স্বভাববিপুল ভাষা কাদম্বরীতে পূৰ্ণবর্ষার নদীর মতো আবর্তে তরঙ্গে গর্জনে আলোকচ্ছটায় বিচিত্র হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু কাদম্বরীর বিশেষ মাহাত্ম্য এই যে, ভাষা ও ভাবের বিশাল বিস্তার রক্ষা করিয়াও তাহার চিত্রগুলি জাগিয়া উঠিয়াছে। সমস্ত প্লাবিত হইয়া একাকার হইয়া যায় নাই, কাদম্বরীর প্রথম আরম্ভ-চিত্রটিই তাহার প্রমাণ । তখনো ভগবান মরীচিমালী অধিক দূরে উঠেন নাই ; নূতন পদ্মগুলির পত্রপুট একটু খুলিয়া গিয়াছে, আর তার পাটল আভাটি কিঞ্চিৎ উন্মুক্ত হইয়াছে। এই বলিয়া বর্ণনা আরম্ভ হইল। এই বর্ণনার আর-কোনো উদ্দেশ্য নাই, কেবল শ্রোতার চক্ষে একটি কোমল রঙ মাখাইয়া দেওয়া এবং তাহার সর্বাঙ্গে একটি স্নিগ্ধ সুগন্ধ ব্যজন দুলাইয়া দেওয়া । একদা তু নাতিদূরোদিতে নিবনলিনদলসম্পূর্টভিদি কিঞ্চিদুমুক্তপাটলিমি ভগবতি মরীচিমালিনি— কথার কী মোহ ! অনুবাদ করিতে গেলে শুধু এইটুকু ব্যক্ত হয় যে, তরুণ সূর্যের বর্ণ ঈষৎ রক্তিম, কিন্তু ভাষার ইন্দ্ৰজালে কেবলমাত্র ঐ বিশেষ্যবিশেষণের বিন্যাসে একটি সুরম্য সুগন্ধ সুবর্ণ সুশীতল প্রভাতকাল অনতিবিলম্বে হৃদয়কে আচ্ছন্ন করিয়া ধরে । এ যেমন প্ৰভাতের, তেমনি একটি কথার তপোবনে সন্ধ্যাসমাগমের বর্ণনা উদধূত করি। — দিব্যাবসানে লোহিত্যতারকা তপোবনধেনুরিব কপিলা পরিবর্তমােনা সন্ধ্যা । দিনশেষে তপোবনের রক্তচক্ষু ধেনুটি যেমন গোষ্ঠে ফিরিয়া আসে, কপিলবৰ্ণা সন্ধ্যা তেমনি তপোবনে অবতীর্ণ । কপিলা৷ ধেনুর সহিত সন্ধ্যার রঙের তুলনা করিতে গিয়া সন্ধার সমস্ত শান্তি ও শ্রান্তি এবং ধূসরচ্ছায়া কবি মুহুর্তেই মনের মধ্যে ঘনাইয়া তুলিতেছেন । সকালের বর্ণনায় যেমন কেবলমাত্র তুলনাচ্ছিলে উন্মুক্তপ্রায় নীলপদ্মাপটের সুকোমল আভাসটুকুর বিকাশ করিয়া মায়াবী চিত্রকর সমস্ত প্ৰভাতকে সীেকুমার্যে এবং সুস্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ করিয়া তুলিয়াছেন, তেমনি বর্ণের উপমাচ্ছলে তপোবনের গোষ্ঠেফেরা অরুণচক্ষু কপিলবৰ্ণ ধেনুটির কথা তুলিয়া সন্ধ্যার যত-কিছু ভাব সমস্ত নিঃশেষে বলিয়া লইয়াছেন। এমন বর্ণসৌন্দর্যবিকাশের ক্ষমতা সংস্কৃত কোনাে কবি দেখাইতে পারেন নাই। সংস্কৃত কবিগণ লাল রঙকে লাল রঙ বলিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছেন, কিন্তু কাদম্বরীকারের লাল রঙ কতরকমের তাহার সীমা নাই। কোনো লাল। লাক্ষালোহিত, কোনো লাল পারাবতের পদতলের মতো, কোনো লাল রক্তাক্ত সিংহনখের সমান। একদা তু প্রভাতসন্ধ্যারাগালোহিতে গগনতলে কমলিনীমধুরক্তপক্ষাসংপুটে বৃদ্ধহংসে ইব মন্দাকিনীপুলিনাদপরজলনিধিতটমবতরতি চন্দ্রমসি, পরিণতরঙ্কুরোমপাণ্ডুনি ব্ৰজতি বিশালতাম। আশাচক্রবালে, গজরুধিররক্তহরিসটালোমলোহিনীভিঃ আতপ্তলাক্ষিকতন্তুপাটলাভিঃ আয়ামিনীভিরশিশিরকিরণদীধিতিভিঃ, পদ্মরাগশালাকাসম্মার্জনীভিরিব সমুৎসাৰ্যমাণে গগনকুট্টিমকুসুমপ্রকরে তারাগণে- একদিন আকাশ যখন প্রভাত-সন্ধ্যােরাগে লোহিত, চন্দ্র তখন পদ্মমধুর-মতে-রক্তবর্ণ-পক্ষপুট-শালী বৃদ্ধহংসের ন্যায় মন্দাকিনীপুলিন হইতে পশ্চিমসমুদ্রতটে অবতরণ করিতেছেন, দিকচক্রবালে বৃদ্ধ রন্ধুমুগের মতো একটি পাণ্ডুত ক্রমশ বিস্তীর্ণ হইয়াছে, আর গজরুধিরক্ত সিংহজটার লোমের ন্যায় লোহিত এবং ঈষৎ তপ্ত লাক্ষাতন্তুর ন্যায় পটলবৰ্ণ সুদীর্ঘ সূর্যরশ্মিগুলি ঠিক যেন পদ্মরাগশালাকার সম্মার্জনীর ন্যায় গগনকুট্টিম হইতে নক্ষত্রপুষ্পগুলিকে সমুৎসারিত করিয়া দিতেছে। - 物