পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१8० রবীন্দ্র-রচনাবলী ক্ষিতিতলনিহিতজানুকরকমলা হইয়া নিবেদন করিল, "দক্ষিণাপথ হইতে চণ্ডালকন্যা একটি পিঞ্জীরস্থ শুক লইয়া কহিতেছে যে, মহারাজ সমুদ্রের ন্যায় সকল ভুবনতলের সর্বরত্বের একমাত্ৰ ভাজন, এই বিহঙ্গটিও একটি পরমাশ্চর্য রত্নবিশেষ বলিয়া দেবপদমূলে প্ৰদান করিবার জন্য আমি আগত হইয়াছি, অতএব দেবদর্শনসুখ অনুভব করিতে ইচ্ছা করি।” পাঠকগণ মনে করিবেন না প্রতিহারী এত সংক্ষেপে নিস্কৃতি পাইয়াছে; অকৃপণা কবিপ্রতিভা তাহার প্রতিও অজস্র কল্পনাবর্ষণ করিয়াছে- তাহার বামপার্থে অঙ্গনাজনবিরুদ্ধ কিরীচাস্ত্ৰ লম্বিত থাকাতে তাহাকে বিষধরজড়িত চন্দনলতার মতো ভীষণ-রমণীয় দেখিতে হইয়াছে, সে শরৎলক্ষ্মীর ন্যায় কলহংসগুভ্ৰবসনা এবং বিন্ধাবনভূমির ন্যায় বেত্ৰিলতাবতী ; সে যেন মূর্তিমতী রাজাজ্ঞা, যেন বিগ্রহিণী রাজ্যাধিদেবতা । সমীপবতী রাজগণের মুখাবলোকন করিয়া উপজাতকুতুহল রাজা প্রতিহারীকে কহিলেন, তাহাকে প্ৰবেশ করিতে দাও । প্ৰতিহারী তখন চণ্ডালকন্যাকে সভাস্থলে উপস্থিত করিল। সেখানে অশনিভয়পুঞ্জিত-শৈলশ্রেণী:মধ্যগত কনকশিখরী মেরুর ন্যায় নরপতি-সহস্রমধ্যবর্তী রাজা । নানা রত্নাভরণ কিরণজালে তাহার অবয়ব প্রচ্ছন্নপ্ৰায় হওয়াতে মনে হইতেছে যেন সহস্ৰ ইন্দ্রায়ুধে অষ্টদিগবিভাগ আচ্ছাদিত করিয়া বর্ষাকালের ঘন-গভীর দিন বিরাজমান। লম্বিতস্থূলমুক্তাকলাপ ও স্বৰ্ণশ্বাস্থলে-বদ্ধ মণিদণ্ডচতুষ্টয়ে অমল শুভ্র অনতিবৃহৎ দুকুলবিতান বিস্তৃত, তাহারই অধোভাগে ইন্দুকান্তমণিপৰ্যাঙ্কে রাজা নিষন্ন ; তাহার পার্থে কনকদণ্ড চামরাকলাপ উদধূয়মান ; পরাভবপ্রণত শশীর ন্যায় বিশদোজ্জ্বল স্ফটিকপাদপীঠে তাহার বামপদ বিন্যস্ত ; আমৃতফেনের ন্যায় র্তাহার লঘুশুভ্ৰ দুকূলবসনের প্রান্তে গোরোচনার দ্বারা হংসমিথুনমালা অঙ্কিত ; অতি সুগন্ধ চন্দনানুলেপনে তাহার উরঃস্থল ধবলিত, তাহারই মধ্যে মধ্যে কুসুমচচিত হওয়াতে স্থানে স্থানে নিপতিত প্ৰভােতরবিকিরণে অঙ্কিত কৈলাসশিখরীর ন্যায় তিনি শোভমান ; ইন্দ্ৰনীল অঙ্গদযুগলে তিনি দুই বাহুতে চপল রাজলক্ষ্মীকে যেন বাধিয়া রাখিয়াছেন ; তাহার কর্ণোৎপল ঈষৎ আলম্বিত, মস্তকে আমোদিত মালতীমালা, যেন উষাকালে অস্তচলশিখরে তারকাপুঞ্জ পর্যন্ত । সেবাসংগত অঙ্গনাগণ দিগবধূর ন্যায় তাহাকে বেষ্টন করিয়া আছে। তখন প্রতিহারী নরপতিকে প্রবুদ্ধ করিবার জন্য রক্তকুবলয়দলকোমল হস্তে বেণুলতা গ্রহণ করিয়া একবার সভাকুট্টিমে আঘাত করিল। তৎক্ষণাৎ তালফলপতনশব্দে বনকরীযুথের ন্যায় রাজগণ মুখ আবলিত করিয়া তদাভিমুখে দৃষ্টিপাত করিলেন । তাহারা দেখিলেন, আর্যবেশধারী ধবলবসন একটি বৃদ্ধ চণ্ডাল অগ্ৰে আসিতেছে, তাহার পশ্চাতে কাকপক্ষধারী একটি বালক স্বর্ণশিলাকা নির্মিত পিঞ্জরে বিহঙ্গকে বহন করিয়া আনিতেছে । এবং তাহার পশ্চাতে নিদ্রার ন্যায় লোচনগ্ৰাহিণী এবং মূৰ্ছার ন্যায় মনােহরা একটি তরুণযৌবনী কন্যা— অসুরগৃহীত অমৃত অপহরণের জন্য কপটপটুবিলাসিনীবেশধারী ভগবান হরির ন্যায় সে শ্যামবর্ণ, যেন একটি সঞ্চারিণী ইন্দ্ৰনীলমণিপুত্তলিকা ; আগুলফবিলম্বিত নীলকন্ধুকের দ্বারা তাহার শরীর আচ্ছন্ন এবং তাহারই উপরে রক্তাংশুকের অবগুণ্ঠনে যেন নীলোৎপলবনে সন্ধ্যালোক পড়িয়ছে ; একটি কর্ণের উপরে উদয়েমুখ-ইন্দু-কিরণচ্ছটার ন্যায় একটি শুভ্ৰ কেতকীপত্র আসক্ত ; ললাটে রক্তচন্দনের তিলক, যেন কিরাতবেশী ত্ৰিলোচনা ভবানী । আমাদের সমালোচ্য চিত্তের বিষয়টি কিঞ্চিৎ সংক্ষেপে অনুবাদ করিয়া দিলাম। সংস্কৃত কবিদের মধ্যে চিত্রাঙ্কনে বাণট্টের সমতুল্য কেহ নাই, এ কথা আমরা সাহস করিয়া বলিতে পারি। সমস্ত কদম্বরী কাব্য একটি চিত্রশালা । সাধারণত লোকে ঘটনা বর্ণনা করিয়া গল্প করে ; বাণভট্ট পরে পরে চিত্র সজিত করিয়া গল্প বলিয়াছেন ; এজন্য তাহার গল্প গতিশীল, নহে, তাহা বর্ণচ্ছটায় অঙ্কিত । চিত্রগুলিও যে ঘনসংলগ্ন ধারাবাহিক তাহা নহে ; এক-একটি ছবির চারিদিকে প্রচুর কারুকার্যবিশিষ্ট বহুবিস্তৃত ভাষার সোনার ফ্রেম দেওয়া, ফ্ৰেম-সমেত সেই ছবিগুলির সৌন্দর্য আস্বাদনে যে বঞ্চিত সে দুৰ্ভাগ্য । NIR S \OOV)