পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ88 রবীন্দ্র-রচনাবলী সুহৃদের ন্যায় সমস্ত বিশ্রম্ভব্যাপারে ইহাকে অভ্যন্তরে লইয়ো, এবং এই কল্যাণীকে এমত সকল কার্যে নিযুক্ত করিয়ো যাহাতে এ তোমার অতিচিরপরিচারিকা হইতে পারে।” কৈলাস এই কথা বলিতেই পত্ৰলেখা তাহাকে অভিজাতপ্ৰণাম করিল ও চন্দ্রপীড় তাহাকে অনিমেষলোচনে সুচিরকাল নিরীক্ষণ পত্ৰলেখা পত্নী নহে, প্ৰণয়িনীও নহে, কিংকরীও নহে, পুরুষের সহচরী। এইপ্ৰকার অপরূপ সখীত্ব দুই সমুদ্রের মধ্যবর্তী একটি বালুতটের মতো— কেমন করিয়া তাহা রক্ষা পায় ? নবযৌবন কুমারকুমারীর মধ্যে অনাদিকালের যে চিরন্তন প্রবল আকর্ষণ আছে তাহা দুই দিক হইতেই এই সংকীর্ণ বাধাটুকুকে ক্ষয় করিয়া লঙ্ঘন করে না কেন ? কিন্তু কবি সেই অনাথ রাজকন্যাকে চিরদিনই এই অপ্রশস্ত আশ্রয়ের মধ্যে বসাইয়া রাখিয়াছেন, এই গণ্ডির রেখামাত্ৰ-বাহিরে তাহাকে কোনোদিন টানেন নাই। হতভাগিনী বন্দিনীর প্রতি কবির ইহা অপেক্ষা উপেক্ষা আর কী হইতে পারে ? একটি সূক্ষ্ম যবনিকার আড়ালে বাস করিয়াও সে আপনার স্বাভাবিক স্থান পাইল না । পুরুষের হৃদয়ের পার্শ্বে সে জাগিয়া রহিল, কিন্তু ভিতরে পদার্পণ করিল না। কোনোদিন একটা অসতর্ক বসন্তের বাতাসে এই সখীত্ব-পর্দার একটি প্রান্তও উড়িয়া পড়িল না । অথচ সখীত্বের মধ্যে লেশমাত্র অন্তরাল ছিল না । কবি বলিতেছেন, পত্ৰলেখা সেই প্রথম দিন ভ্ৰমণে ছায়ার মতো রাজপুত্রের পার্শ্ব পরিত্যাগ করিল না। চন্দ্রাপীড়েরও তাঁহাকে দেখা অবধি প্রতিক্ষণে উপচীয়মানা মহতী প্রীতি জন্মিল | প্ৰতিদিন ইহার প্রতি প্ৰসাদ রক্ষা করিলেন এবং সমস্ত বিশ্বাসকার্যে ইহাকে আত্মহৃদয় হইতে অব্যাতিরিক্ত মনে করিতে লাগিলেন । । এই সম্বন্ধটি অপূর্ব সুমধুর, কিন্তু ইহার মধ্যে নারী-অধিকারের পূর্ণতা নাই ; নারীর সহিত নারীর যেরূপ লজ্জাবোধহীন সখীসম্পর্ক থাকিতে পারে পুরুষের সহিত তাহার সেইরূপ অসংকোচ অনবচ্ছিন্ন নৈকট্য পত্ৰলেখার নারীমৰ্যাদার প্রতি কাদম্বরীকাব্যের যে একটা অবজ্ঞা প্রকাশ পায় তাহাতে কি পাঠককে আঘাত করে না ? কিসের আঘাত ? আশঙ্কার নহে, সংশয়ের নহে। কারণ, কবি যদি আশঙ্কা, সংশয়েরও লেশমাত্র স্থান রাখিতেন তবে সেটা আমরা পত্ৰলেখার নারীত্বের প্রতি কথঞ্চিৎ সম্মান বলিয়া গ্ৰহণ করিতাম। কিন্তু এই দুটি তরুণ-তরুণীর মধ্যে লজ্জা আশঙ্কা এবং সন্দেহের দোদুল্যমান স্নিগ্ধ ছায়াটুকু পর্যন্ত নাই। পত্ৰলেখা তাহার অপূর্বসম্বন্ধবশত অন্তঃপুর তো ত্যাগই করিয়াছে কিন্তু স্ত্রী পুরুষ পরস্পর সমীপবর্তী হইলে স্বভাবতই যে-একটি সংকোচে সাধ্বসে এমন-কি সহাস্য ছলনায় একটি লীলান্বিত কম্পমান মানসিক অন্তরাল আপনি বিরচিত হইতে পারে, ইহাদের মধ্যে সেটুকুও হয় নাই। সেই কারণেই এই অন্তঃপুরবিচ্যুতা অন্তঃপুরিকার জন্য সর্বদাই ক্ষোভ জন্মিতে থাকে । চন্দ্রাপীড়ের সহিত পত্ৰলেখার নৈকটাও অসামান্য। দিগবিজয়যাত্রার সময় একই হন্তীপৃষ্ঠে পত্ৰলেখাকে সম্মুখে বসাইয়া রাজপুত্র আসন গ্রহণ করেন। শিবিরে রাত্রিকালে চন্দ্রপীড় যখন নিজশয্যার অনতিদূরে শয়ননিষঃ পুরুষসখা বৈশম্পায়নের সহিত আলাপ করিতে থাকেন তখন নিকটে ক্ষিতিতালবিন্যস্ত কুথার উপর সখী পত্ৰলেখা প্রসুপ্ত থাকে। অবশেষে কাদম্বরীর সহিত চন্দ্রাপীড়ের যখন প্রণয়সংঘটন হইল। তখনো পত্ৰলেখা আপন ক্ষুদ্র স্থানটুকুর মধ্যে অব্যাহতভাবে রহিল। কারণ, পুরুষচিত্তে নারী যতটা আসন পাইতে পারে তাহার সংকীর্ণতম প্রান্তটুকু মাত্র সে অধিকার করিয়াছিল— সেখানে যখন মহামহােৎসবের জন্য স্থান করিতে হইল, তখন ঐটুকু প্ৰান্ত হইতে বঞ্চিত করা আবশ্যকই হইল না। পত্ৰলেখার প্রতি কাদম্বুরীর ঈর্ষার আভাসমােত্রও ছিল না। এমন-কি, চন্দ্ৰাপীড়ের সহিত পত্ৰলেখার প্রীতিসম্বন্ধ বলিয়াই কাদম্বরী তাহাকে প্ৰিয়সখীজ্ঞানে সাদরে গ্রহণ করিল। কাদম্বরীকাব্যের মধ্যে পত্ৰলেখা যে অপরূপ ভূখণ্ডের মধ্যে আছে সেখানে ঈর্ষা সংশয় সংকট বেদনা কিছুই নাই, তাহা স্বর্গের ন্যায় নিষ্কণ্টক, অথচ সেখানে স্বর্গের অমৃতবিন্দু কই ?