পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

R(?や রবীন্দ্র-রচনাবলী পরনে তার ডুরে শাড়ি ঘুরে পড়েছে। দুই দিকে দুই কাৎলা মাছ ভেসে উঠেছে। একটি নিলেন গুরুষ্ঠাকুর, একটি নিলেন টিয়ে ৷ টিয়ের মার বিয়ে নাল গামছা দিয়ে ৷ অশাথের পাতা ধনে । গৌর বেটী কনে ৷ নক বেটা বর ! ঢ্যাম কুড়া কুড় বান্দি বাজে, চড়কডাঙায় ঘর ৷ এই সকল ছড়ার মধ্য হইতে সত্য অন্বেষণ করিতে গেলে বিষম বিভ্রাটে পড়িতে হইবে । প্রথম ছড়ায় দেখিয়াছি আলোচাল খাইয়া সীতারাম-নামক নৃত্যুপ্রিয় লুব্ধ বালকটিকে ত্রিপূর্ণির ঘাটে জল খাইতে যাইতে হইয়াছিল ; দ্বিতীয় ছড়ায় দেখিতে পাই সীতানাথ চালকড়াই খাইয়া জলের অন্বেষণে চিৎপুরের মাঠে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিল ; কিন্তু তৃতীয় ছড়ায় দেখা যাইতেছে- সীতারামও নহে, সীতানাথও নহে, পরন্তু কোনাে-এক হতভাগিনী ভ্রাতৃজায়ার বিদ্বেষপরায়ণা ননদিনী জন্তিফল-ভক্ষণের পর তৃষাতুর হইয়া হরগীেরীর মাঠে পান খাইতে গিয়াছিল এবং পরে অসাবধানা ভ্ৰাতৃবধূর তুচ্ছ অপরাধটুিকু দাদাকে বলিয়া দিবার জন্য পাড়া তোলপাড় করিয়া তুলিয়ছিল। এই তো তিন ছড়ার মধ্যে অসংগতি । তার পর প্রত্যেক ছড়ার নিজের মধ্যেও ঘটনার ধারাবাহিকতা দেখা যায় না। বেশ বুঝা যায়, অধিকাংশ কথাই বানানো। কিন্তু ইহাও দেখিতে পাই, কথা বানাইতে গেলে লোকে প্রমাণের প্রাচুর্য দ্বারা সেটাকে সত্যের অপেক্ষা অধিকতর বিশ্বাসযোগ করিয়া তোলে ; অথচ এ ক্ষেত্রে সে পক্ষে খেয়ালমাত্র নাই । ইহাদের কথা সত্যও নহে, মিথ্যাও নহে ; দুইয়ের বার। ঐ-যে ছড়ার এক জায়গায় সুবলের বিবাহের উল্লেখ আছে সেটা কিছু অসম্ভব ঘটনা নহে । কিন্তু সত্য বলিয়াও বোধ হয় না । দাদা দাদা ডাক ছাড়ি, দাদা নাইকো বাড়ি । সুবল সুবল ডাক ছাড়ি, সুবল আছে বাড়ি ৷ যেমনি সুবলের নামটা মুখে আসিল অমনিই বাহির হইয়া গেল, ‘আজ সুবলের অধিবাস কাল সুবলের বিয়ে।' সে কথাটাও স্থায়ী হইল না, অনতিবিলম্বেই দিগনগরের দীর্ঘকেশ মেয়েদের কথা উঠিল। স্বপ্নেও ঠিক এইরূপ ঘটে । হয়তো শব্দসাদৃশ্য অথবা অন্য কোনো অলীক তুচ্ছ সম্বন্ধ অবলম্বন করিয়া মুহুর্তে মুহুর্তে একটা কথা হইতে আর-একটা কথা রচিত হইয়া উঠিতে থাকে। মুহুর্তকাল পূর্বে তাহাদের সম্ভাবনার কোনোই কারণ ছিল না, মুহুর্তকাল পরেও তাহারা সম্ভাবনার রাজ্য হইতে বিনা চেষ্টায় অপসৃত হইয়া যায়। সুবলের বিবাহকে যদি বা পাঠকগণ তৎকালীন ও তৎস্থানীয় কোনো সত্য ঘটনার আভাস বলিয়া জ্ঞান করেন, তথাপি সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিবেন “নাল গামছা দিয়ে টিয়ের মার বিয়ে কিছুতেই সাময়িক ইতিহাসের মধ্যে স্থান পাইতে পারে না। কারণ, বিধবাবিবাহ টিয়েজাতির মধ্যে প্রচলিত থাকিলেও নাল গামছার ব্যবহার উক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে কস্মিন কালে শুনা যায় নাই। কিন্তু যাহাদের কাছে ছন্দের তালে তালে সুমিষ্ট কণ্ঠে এই-সকল অসংলগ্ন অসম্ভব ঘটনা উপস্থিত করা হইয়া থাকে তাহারা বিশ্বাসও করে না, সন্দেহও করে না, তাহারা মনশ্চক্ষে স্বপ্নবৎ প্ৰত্যক্ষবৎ ছবি দেখিয়া যায় । বালকেরা ছবিও অতিশয় সহজে স্বল্পায়ােজনে দেখিতে পায়। ইহার কারণ পূর্বে এক স্থলে বলিয়াছি, ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধে বালকের সহিত দেবতার একটা সাদৃশ্য দেখা যায়। বালক যত সহজে ইচ্ছামাত্রই সৃজন করিতে পারে আমরা তেমন পারি না। ভাবিয়া দেখো, একটা গ্ৰন্থিবাধা বস্ত্ৰখণ্ডকে মুণ্ডবিশিষ্ট মনুষ্য কল্পনা করিয়া তাহাকে আপনার সন্তানরূপে লালন করা সামান্য ব্যাপার নহে।