পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ՏՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী সাহিত্যনীতির ব্যভিচার, এবং সর্ববিষয়েই রূঢ়তা ও অসংযম দেখিতে পাওয়া যায়। অচিরকালেই সাধারণের এমন উন্নতি হইবে যে, তাহার অবসর-বিনোদনের মধ্যেও ভদ্রোচিত সংযম, গভীরতর সত্য এবং দুরূহতার আদর্শের প্রতিষ্ঠা দেখিতে পাইব । তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই | আমরা সাধারণ এবং সমগ্ৰ ভাবে কবির দলের গানের সমালোচনা করিয়াছি । স্থানে স্থানে সে-সকল গানের মধ্যে সৌন্দর্য এবং ভাবের উচ্চতাও আছে- কিন্তু মোটের উপর এই গানগুলির মধ্যে ক্ষণস্থায়িত্ব, রসের জলীয়তা এবং কাব্যকলার প্রতি অবহেলাই লক্ষিত হয় ; এবং সেরূপ হইবার প্রধান কারণ, এই গানগুলি ক্ষণিক উত্তেজনার জন্য উপস্থিতমত রচিত । তথাপি এই নষ্টপরমায়ু 'কবি'র দলের গান আমাদের সাহিত্য এবং সমাজের ইতিহাসের একটি অঙ্গ, এবং ইংরাজ-রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক । ७ाले ९७०२ গ্ৰাম্যসাহিত্য একদিন শ্রাবণের শেষে নীেকা করিয়া পাবনা-রাজশাহির মধ্যে ভ্ৰমণ করিতেছিলাম ! মাঠ ঘাট সমস্ত জলে ডুবিয়াছে। ছােটাে ছোটাে গ্রামগুলি জলচর জীবের ভাসমান কুলায়পুঞ্জের মতো মাঝে মাঝে জাগিয়া আছে। কুলের রেখা দেখা যায় না, শুধু জল ছলছল করিতেছে। ইহার মধ্যে যখন সূর্য অস্ত যাইবে এমন সময়ে দেখা গেল প্ৰায় দশ-বারো জন লোক একখানি ডিঙি বাহিয়া আসিতেছে । তাহারা সকলে মিলিয়া উচ্চকণ্ঠে এক গান ধরিয়াছে এবং দাড়ের পরিবর্তে এক-একখানি বাখ্যারি দুই হাতে ধরিয়া গানের তালে তালে ঝোকে ঝোকে ঝাপ ঝাপ শব্দে জল ঠেলিয়া দ্রুতবেগে চলিয়াছে। গানের কথাগুলি শুনিবার জন্য কান পাতিলাম, অবশেষে বারংবার আবৃত্তি শুনিয়া যে ধুয়াটি উদ্ধার করিলাম তাহা এই— যুবতী, ক্যান বা কর মন ভারী। পাবনা থ্যাহে আন্যে দেব ট্যাহা-দামের মোটর ॥ ভরা বর্ষার জলপ্লাবনের উপর যখন নিঃশব্দে সূর্য অস্ত যাইতেছে। এ গানটি ঠিক তখনকার উপযুক্ত কি না সে সম্বন্ধে পাঠকমাত্রেরই সন্দেহ হইতে পারে, কিন্তু গানের এই দুটি চরণে সেই শৈবালবিকীর্ণ জলমরুর মাঝখান হইতে সমস্ত গ্রামগুলি যেন কথা কহিয়া উঠিল । দেখিলাম, এই গোয়ালঘরের পাশে, এই কুলগাছের ছায়ায়, এখানেও যুবতী মন-ভারী করিয়া থাকেন এবং তাহার রোষারুণ কুটিল কটাক্ষপাতে গ্ৰাম্য কবির কবিতা ছন্দে-বন্ধে সুরে-তালে মাঠে-ঘাটে জলে-স্থলে জাগিয়া উঠিতে থাকে। জগতে যতপ্রকার দুর্বিপাক আছে যুবতীচিত্তের বিমুখত তাহার মধ্যে অগ্রগণ্য ; সেই দুরগ্রহ-শাস্তির জন্য কবিরা ছন্দোরচনা এবং প্ৰিয়প্ৰসাদবঞ্চিত হতভাগ্যগণ প্ৰাণপাত পর্যন্ত করিতে প্ৰস্তুত । কিন্তু যখন গানের মধ্যে শুনিলাম ‘পাবনা থেকে আনি দিব টাকা দামের মোটরি, তখন ক্ষণকালের জন্য মনের মধ্যে বড়ো একটা আশ্বাস অনুভব করা গেল। মেটরি পদার্থটি কী তাহা ঠিক জানি না, কিন্তু তাহার মূল্য যে এক টাকার বেশি নহে কবি তাঁহাতে সন্দেহ রাখেন নাই। জগতের এক প্রান্তে পাবনা জিলায় যে এমন একটা স্থান আছে যেখানে প্রতিকূল প্ৰণয়িনীর জন্য অসাধ্যসাধন করিতে হয় না, পাবনা অপেক্ষা দুৰ্গম স্থানে যাইতে এবং ‘মেটরি অপেক্ষা দুর্লভ পদার্থ সংগ্ৰহ করিতে হয় না, ইহা মনে করিলে ভাবযন্ত্রণা অপেক্ষাকৃত সুসহ বলিয়া বােধ হয়। কালিদাস ভবভূতি প্রভৃতি প্রথম শ্রেণীর কবিরা এমন স্থলে নিশ্চয়ই মানসসরোবরের স্বর্ণপদ্ম, আকাশের তারা এবং নন্দনকাননের পারিজাত অম্লানমুখে হাঁকিয়া বসিতেন। এবং উজ্জয়িনীর প্রথম শ্রেণীর যুবতীরা শিখরিণী ও মন্দাক্রাস্তাচ্ছন্দে এমন দুঃসাধ্য অনুষ্ঠানের প্রস্তাবমাত্ৰ শুনিলে প্ৰসন্ন না হইয়া থাকিতে পারিতেন না । অন্তত কাব্য পড়িয়া এইরূপ ভ্ৰম হয় । কিন্তু অবিশ্বাসী গদ্যজীবী লোকেরা এতটা কবিত্ব বিশ্বাস করে