পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ՏԵr রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক দুর্ঘটনা । ইহা লইয়া দুশ্চিন্তা, অনুতাপ, অশ্রুপাত, জামাতৃপরিবারের সহিত বিরোধ, পিতৃকুল ও পতিকুলের মধ্যবর্তনী বালিকার নিষ্ঠুর মর্মবেদনা, সর্বদাই ঘরে ঘরে উদভূত হইয়া থাকে। একান্নপরিবারে আমরা দূর ও নিকট, এমন-কি, নামমাত্র আত্মীয়কেও বঁধিয়া রাখিতে চাই- কেবল কন্যাকেই ফেলিয়া দিতে হয়। যে সমাজে স্বামী-স্ত্রী ব্যতীত পুত্রকন্যা প্রভৃতি সকলেই বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, তাহারা আমাদের এই দুঃসহ বেদনা কল্পনা করিতে পরিবে না। আমাদের মিলনধমী পরিবারে এই একমাত্র বিচ্ছেদ। সুতরাং ঘুরিয়া ফিরিয়া সর্বদাই সেই ক্ষতবেদনায় হাত পড়ে। হরগীেরীর কথা বাংলার একান্নপরিবারের সেই প্রধান বেদনার কথা । শরৎ-সপ্তমীর দিনে সমস্ত বঙ্গভূমির ভিখারি-বধু কন্যা মাতৃগৃহে আগমন করে, এবং বিজয়ার দিনে সেই ভিখারিঘরের অন্নপূর্ণ যখন স্বামীগৃহে ফিরিয়া যায় তখন সমস্ত বাংলাদেশের চােখে জল ভরিয়া আসে। এই সকল কারণে হরগীেরী-সম্বন্ধীয় গ্রাম্যছড়াগুলি বাস্তব ভাবের । তাহা রচয়িতা ও শ্রোতৃবর্গের একান্ত নিজের কথা। সেই সকল কাব্যে জামাতার নিন্দা, স্ত্রীপুরুষের কলহ ও গৃহস্থালীর বর্ণনা যাহা আছে তাহাতে রাজভাব বা দেবভাব কিছুই নাই ; তাহাতে বাংলাদেশের গ্রাম্য কুটিরের প্রাত্যহিক দৈন্য ও ক্ষুদ্রতা সমস্তই প্রতিবিম্বিত। তাঁহাতে কৈলাস ও হিমালয় আমাদের পানা-পুকুরের ঘাটের সম্মুখে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, এবং তাঁহাদের শিখররাজি আমাদের আম-বাগানের মাথা ছাড়াইয়া উঠিতে পারে নাই। যদি তাহারা নিজ নিজ অভ্ৰভেদী মূর্তি ধারণ করিবার চেষ্টমাত্র করিতেন তাহা হইলে বাংলার গ্রামের মধ্যে র্তাহাদের স্থান হইত না । শরৎকালে রানী বলে বিনয়বাচন আর শুনেছি, গিরিরাজ, নিশার স্বপন ? এই স্বপ্ন হইতে কথা আরম্ভ। সমস্ত আগমনী গানের এই ভূমিকা | প্রতি বৎসর শরৎকালে ভোরের বাতাস যখন শিশিরসিক্ত এবং রৌদ্রের রঙ কঁচা সোনার মতো হইয়া আসে, তখন গিরিরানী সহসা একদিন তাহার শ্মশানবাসিনী সোনার গৌরীকে স্বপ্ন দেখেন, আর বলেন ; আর শুনেছ গিরিরাজ নিশার স্বপন ? এ স্বপ্ন গিরিরাজ আমাদের পিতামহ এবং প্রপিতামহদের সময় হইতে ললিত বিভাস এবং রামকেলি রাগিণীতে শুনিয়া আসিতেছেন, কিন্তু প্ৰত্যেক বৎসরই তিনি নূতন করিয়া শোনেন। ইতিবৃত্তের কোন বৎসরে জানি না, হরগীেরীর বিবাহের পরে প্রথম যে শরতে মেনকারানী স্বপ্ন দেখিয়া প্ৰত্যুষে জাগিয়া উঠিয়াছিলেন সেই প্রথম শরৎ সেই তাহার প্রথম স্বপ্ন লইয়াই বর্ষে বর্ষে ফিরিয়া ফিরিয়া আসে। জলে স্থলে আকাশে একটি বৃহৎ বেদনা বাজিয়া উঠে, যাহাকে পরের হাতে দিয়াছি আমার সেই আপনার ধন কোথায় ! বৎসর গত হয়েছে কত, করছে শিবের ঘর । যাও গিরিরাজ আনতে গৌরী কৈলাসশিখর ৷ বলা বাহুল্য, গিরিরাজ নিতান্ত লঘু লোকটা নহেন। চলিতে ফিরিতে, এমন-কি, শোক-দুঃখ-চিন্তা অনুভব করিতে, তাহার স্বভাবতই কিঞ্চিৎ বিলম্ব ঘটিয়া থাকে। তঁহার সেই সর্বাঙ্গীণ জড়তা ও ঔদাসীন্যের জন্য একবার গৃহিণীর নিকট গোটাকয়েক তীব্র তিরস্কার-বাক্য শুনিয়া। তবে তিনি অঙ্কুশাহত হন্তীর ন্যায় গাত্ৰোখান করিলেন । , 的 শুনে কথা গিরিরাজা লজ্জায় কাতর পঞ্চমীতে যাত্রা করে শাস্ত্রের বিচার । তা শুনি মেনকারানী শীঘ্ৰগতি ধরি খাজা মণ্ড মনোহর দিলেন ভাণ্ড ভরি ॥ মিশ্ৰিসাচ চিনির ফেনি ক্ষীর তক্তি সরে চিনির ফেনা এলাচদানা মুক্ত থরে থরে ৷ ভাঙের লাড়ু সিদ্ধি বলে পঞ্চমুখে দিলেন ভাণ্ড ভরি গিরিরাজ তখনি সে নিলেন ৷