পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br> と রবীন্দ্র-রচনাবলী “রুদ্ধ গৃহ প্ৰবন্ধ ছাপা হওয়ার পর ১২৯২ পৌষের বালক পত্রিকায় কবিবন্ধু ও কবির মধ্যে পত্রচ্ছলে এরূপ ‘উত্তর প্রত্যুত্তর চলে— ‘বন্ধুবর— এবার বালকের আপনার সবগুলিই আমাকে ভালো লাগিল, কেবল "রুদ্ধ গৃহের ভাব ধরিতে পারিলাম না । এক জনের মধ্যেই রুদ্ধ হইয়া থাকা, এক জনকে লইয়াই চিরদিন শোক করা। আপনি গৰ্হিত বলিয়াছেন । কিন্তু কী করা যায় বলুন ! যখন এক চন্দ্রের দিকে চাই তখন আমার দৃষ্টির অপূর্ণতাবশত নক্ষত্রগুলিকে আর দেখিতে পাই না এবং সেই এক চন্দ্র যখন অস্ত যায় তখন নক্ষত্রেরা আমাকে আর তেমন আলো দিতে পারে না। এক দিকে চাহিয়া থাকা, । একের চারি দিকে ঘোরাই প্রকৃতির নিয়ম, তাহাই প্রকৃতির বন্ধনের কারণ। আজ যদি পৃথিবী বলিয়া বসে, আমি সূর্যের চারিদিকে ঘুরিব না, কেননা সূর্যকে মেঘে ঢাকিয়ছে, সূর্য আমাকে আর আলো দেয় না, আমি অন্য আলোকের চেষ্টা দেখি, তাহা হইলে প্রকৃতির বন্ধন ছিন্ন হয়, পৃথিবীর মৃত্যু হয়, সমুদয় ব্ৰহ্মাণ্ড তাহার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হয়। তাই বলিতেছি প্রকৃতির নিয়মই এক দিকে চাহিয়া থাকা— পৃথিবীর ন্যায় এক সূর্যের বন্ধনে অনন্ত শূন্যের মধ্যে দণ্ডায়মান হওয়া । সে বন্ধন না থাকিলে শূন্যের মধ্যে, আঁধারের মধ্যে, ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা । আর-একটি কথা—পৃথিবী এক সূর্যের দিকে চাহিয়া ঘোরে বলিয়া কি তাহার কোটি গ্রহনক্ষত্রের সহিত বন্ধন ছিন্ন হইয়াছে ? না সেই সূত্রেই অনন্তের সহিত পৃথিবীর বন্ধন হইয়াছে ? তাই পর্বত আকাশের মনুষ্যও প্রকৃতির সন্তান, সেও যদি এক দিকে চায় সেও সুন্দর হয় । শ্ৰীঅঃ— —বালক । পৌষ ১২৯২ রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে লিখিয়াছিলেন— ‘সুহৃদবরেষু— আপনার চিঠি পাইয়া আনন্দিত হইলাম । “আপনি "রুদ্ধ গৃহ যে ভাবে বুঝিয়াছেন আমি ঠিক সে ভাবে লিখি নাই। আপনি যাহা বলিয়াছেন সে ঠিক কথা । একের চারি দিকেই আমাদিগকে ঘুরিতে হইবে, নহিলে অনেকের মধ্যে বিলুপ্ত হইয়া যাইব । কিন্তু জগতের মধ্যে আমাদের এমন এক নাই যাহা আমাদের চিরদিনের অবলম্বনীয়। প্রকৃতি ক্ৰমাগতই আমাদিগকে ‘এক হইতে একান্তরে লইয়া যাইতেছে— এক কড়িয়া আর-এক দিতেছে । আমাদের শৈশবের “এক যৌবনের “এক নহে । যৌবনের ‘’এক’ বার্ধক্যের “এক নহে, ইহজন্মের “এক পরজন্মের “এক নহে | এইরূপ শতসহস্ৰ ‘একে’র মধ্য দিয়া প্রকৃতি আমাদিগকে সেই এক মহৎ একের দিকে লইয়া যাইতেছে। সেই দিকেই আমাদিগকে অগ্রসর হইতে হইবে, পথের মধ্যে বদ্ধ হইয়া থাকিতে আসি নাই | জগতের আর-সমস্ত ‘একই পথের মধ্যে মাঝে মাঝে বিশ্রাম করিবার জন্য ; বাস করিবার জন্য নহে । রাত্ৰি প্ৰভাত হইলেই ছাড়িয়া যাইতে হইবে— ‘পডিয়া পড়িয়া শোক করিলে হইবে না । কিছুই থাকিতে চায় না, অথচ আমরা রাখিতে চাই, ইহাই আমাদের যত শোকদুঃখের কারণ। সকলকে যাইতে দাও, এবং তুমিও চলো— জগতের সহিত নিম্বফল সংগ্রাম করিয়ো না।” এই কথা আমরা যেন সার জানি । ‘শূন্যতার ভয় করিবেন না, কিছুই শূন্য থাকিবে না। সমস্ত শূন্য করিয়া দেয় জগতে এমন বিরহ কোথায় ! ক্ষুদ্রতর এক বৃহত্তর একের জন্য স্থান রচনা করিয়া দেয়। হৃদয়ের পুত্তলিকাসকল ভাঙিয়া গেলে ঈশ্বর সেখানে আসিয়া অধিষ্ঠান করেন । প্রিয়তমের মৃত্যুতে জগৎ প্রিয়তম হয়। ক্ষুদ্রকে ভালোবাসিতে আরম্ভ করিয়া বৃহৎকে ভালোবাসিতে শিখি । জগতের কিছুরই মধ্যে আমাদের নিবৃত্তি নাই এবং সে নিবৃত্তি-কামনা করা নিস্ফল ও আমাদের পক্ষে