পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brStr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তাহাদিগকে দূরে তাড়াইয়া দিয়ে না ; তাহাদিগকে ডাকিয়া তাহাদের তৃষা দূর করো ; তোমারই প্রিয়তমের কল্যাণ হইবে। কলম্বস আমেরিকা আবিষ্কার করিয়া সমস্ত আমেরিকা জুড়িয়া যদি নিজের গোরস্থান রচনা করিতেন সে কি তাহার যশের হইত ? সভ্যতার বিলাসভূমি স্বাধীন উন্মুক্ত আমেরিকাই তাহার স্মরণচিহ্ন। জীবনই মৃত্যুর প্রকৃত স্মরণচিহ্ন । পুত্ৰই পিতার যথার্থ স্মরণচিহ্ন, একমুষ্টি চিতাভস্ম নহে। প্রেমের উন্মুক্ত সদাব্রতই প্রেমিকের স্মরণচিহ্ন, পাষাণভিত্তির । মধ্যে নিহিত শোকের কঙ্কাল নহে । ‘প্ৰেম জাহ্নবীর ন্যায় প্রবাহিত হইবার জন্য হইয়াছে । তাহার প্রবহমাণ স্রোতের উপরে শিলমোহরের ছাপ মারিয়া “আমার বলিয়া কেহ ধরিয়া রাখিতে পারে না । সে জন্ম হইতে জন্মান্তরে প্রবাহিত হইবে । তাহার উৎসের মধ্যে গোরের মাটি চাপা দিয়া তাহার প্রবাহ বন্ধ করিবার চেষ্টা কেবল বৃথা কষ্টের কারণ মাত্ৰ । “মৃত্যুকে আমরা যেমন ভয় করি বিস্মৃতিকেও আমরা তেমনি ভয় করি। কিন্তু অনেক সময় সে ভয় অকারণ। বিস্মৃতি মাঝে মাঝে আসিয়া স্মৃতির শৃঙ্খল কাটিয়া দিয়া যায়। আমাদিগকে কিছুক্ষণের মতো স্বাধীন করিয়া দেয়। যখন কোনো কাৰ্য বা ঘটনা হইতে তাহার সমস্ত ফললাভ করিয়া চুকাইয়া দিয়াছি বা তাহারা নিস্ফলভাবে আমাদের কাছে স্তৃপ বাধিয়া আছে, তখন বিস্মৃতি আসিয়া সেই সমস্ত উচ্ছিষ্ট-অবশেষ ও আবৰ্জনা ঝাটাইয়াফেলিয়া দেয়। মিশাইয়া দেয়। প্রতি মুহুর্তের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি জমিয়া জমিয়া অবশেষে আমাদের বাতাস আটক করিতে চাহে, আমাদের নীলাকাশ রোধ করিতে চাহে, পদে পদে আমাদের যাত্রার ব্যাঘাত করে- বিস্মৃতি আসিয়া এই সকল বেড়া ভাঙিয়া দেয়। বিস্মৃতি আমাদের জীবনগ্রন্থের ছেদ, দাড়ি ; মাঝে মাঝে আসিয়া উত্তরোত্তর আমাদের জীবনবিকাশের সহায়তা করে । একটি গ্রন্থের মধ্যে সহস্ৰ দাড়ি আছে, তবে তো তাহাতে ভােব ব্যক্ত ও পরিস্ফুট হইয়াছে। একটি জীবনের মধ্যেও শতসহস্ৰ বিস্মৃতি চাই, তবেই জীবন সম্পূর্ণ হইতে পারে। অতএব ব্যাকরণবিরুদ্ধ একটিমাত্র দীর্ঘস্মৃতি লইয়া জীবন শেষ করিলে জীবন শেষই হয় না। ‘অতএব আমাদিগকে বিস্মৃতির মধ্য দিয়া বৈচিত্র্য ও বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়া অসীম একের দিকে ক্ৰমাগত ধাবমান হইতে হইবে, অন্য পথ দেখি না । তাই বলিয়াছিলাম, দ্বার রুদ্ধ রাখিয়ো নাযে আসে সে আসুক, যে যায়। সে যাক, আমি কেবল গ্ৰীতি ও প্রিয়কাৰ্য সাধন করিব । সোলাপুর। ২৬ আশ্বিন । শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর --বালক । পৌষ ১২৯২ প্ৰাচীন সাহিত্য প্রাচীন সাহিত্য গদ্যগ্রন্থাবলীর দ্বিতীয় ভাগ রূপে ১৩১৪ সালে প্রথম প্রকাশিত। ' প্রাচীন সাহিত্যের ‘ধৰ্ম্মপদং' প্ৰবন্ধটি ভারতবর্ষ গ্রন্থে (রবীন্দ্র-রচনাবলীর চতুর্থ খণ্ডে । সুলভ সংস্করণ, দ্বিতীয় খণ্ডে) মুদ্রিত হইয়াছে বলিয়া এখানে বর্জিত হইল । এই গ্রন্থের প্রথম প্ৰবন্ধ “রামায়ণ দীনেশচন্দ্র সেন-লিখিত ‘রামায়ণী কথা’র ভূমিকা হিসাবে লেখা হয় । এই প্রসঙ্গে কার্তিক-পৌষ ১৩৭৩ সংখ্যা বিশ্বভারতী পত্রিকা এবং চিঠিপত্র দশম খণ্ডে প্রকাশিত দীনেশচন্দ্ৰকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্র দ্রষ্টব্য । ‘প্রাচীন সাহিত্য’ গ্রন্থে পাঠের পরিবর্তন দেখা যায়, বর্তমান গ্রন্থে পূর্বতন পাঠই সংকলন করা হইল ।