পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SCtr রবীন্দ্র-রচনাবলী সন্ধানে এক জায়গায় ম্যাঙ্গনিজের লক্ষণ যেন ধরা পড়েছিল। তাই দ্রুত উৎসাহে চলেছিলুম। কাকগুলো মাথার উপর দিয়ে গেরুয়ারঙের আকাশে কী কী শাজে চলেছিল বাসায় । এমন সময় হঠাৎ বাধা পড়ল আমার কাজে ফেরায় । পাঁচটি শালগাছের বৃহ ছিল বনের পথে একটা টিবির উপরে । সেই বেষ্টনীর মধ্যে কেউ বসে থাকলে কেবল একটিমাত্ৰ ইফাকের মধ্যে দিয়ে তাকে দেখা যায়, হঠাৎ চোখ এড়িয়ে যাবারই কথা । সেদিন মেঘের মধ্যে আশ্চর্য একটা দীপ্তি ফেটে পড়েছিল। বনের সেই ফাকটাতে ছায়ার ভিতরে রাঙা আলো যেন দিগঙ্গানার গাটহেড়া সোনার মুঠোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক সেই আলোর পথে বসে আছে মেয়েটি, গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে পা দুটি বুকের কাছে গুটিয়ে একমনে লিখছে একটি ডায়ারির খাতা নিয়ে। এক মুহুর্তে আমার কাছে প্ৰকাশ পেল একটি অপূর্ব বিস্ময় । জীবনে এরকম দৈবাৎ ঘটে। পূর্ণিমার বান ডেকে আসার মতো কক্ষতটে থাকা দিতে লািগল জোয়ারের ঢেউ । গাছের উড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলুম। একটি আশ্চর্য ছবি চিহ্নিত হতে লািগল মনের চিরস্মরণীয়া গারে । আমার বিস্তৃত অভিজতার পথে অনেক অপ্রত্যাশিত মনোহরের দরজায় ঠেকেছে৷ মন, পাশ কাটিয়ে চলে গেছি, আজি মনে হল জীবনের একটা কোন চরমের সংস্পর্শে এসে পীেছলুম। এমন করে ভাবা, এমন করে বলা আমার একেবারে অভ্যন্ত নয় ; যে-আঘাতে মানুষের নিজের অজানা একটা অপূর্বস্বরূপ ছিটিকিনি খুলে অবরিত হয়, সেই আঘাত আমাকে লািগল কী করে। বরাবর জানি, আমি পাহাড়ের মতো খটখাটে, নিরেট । ভিতর থেকে উছলে পড়ল কারনা। একটা-কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু মানুষের সঙ্গে সব চেয়ে বড়ো আলাপের প্রথম কথাটি কী হতে পারে ভেবে পাই নে। সে হচ্ছে খৃস্টীয় পুরাণের প্রথম সৃষ্টির বাণী, আলো জাগুক, অব্যক্ত হয়ে যাক ব্যক্ত । এক সময়ে মনে হল- মেয়েটি- ওর আসল নাম পরে জেনেছি কিন্তু সেটা ব্যবহার করব না, ওকে নাম দিলুম। অচিরা । মানে কী । মানে এই যার প্রকাশ হতে বিলম্ব হল না, বিদ্যুতের মতো। রইল ঐ নােম । মুখ দেখে মনে হল অচিয়া জানতে পেরেছে, কে একজন আড়ালে দাড়িয়ে আছে । উপস্থিতির একটা নীরব ধ্বনি আছে বুকি । লেখা বন্ধ করেছে, “অখুচি উঠতে পারছে না । পলায়নটা পাছে বড় বেশি স্পষ্ট হয়। একবার ভাবলুম বলি, “মাপ করুন- কী মাপ করা, কী অপরাধ, কী বলব তাকে । একটু তফাতে গিয়ে বিলিতি বেঁটে কোদাল নিয়ে মাটিতে খোচা মারবার ভান করলুম, কুলিতে একটা কী পুরনুলুম, সেটা অত্যন্ত বাজে । তার পরে ঝুঁকে পড়ে মাটিতে বিজ্ঞানী দৃষ্টি চালনা করতে করতে চলে গেলুম। কিন্তু নিশ্চয় মনে জানি, ধাকে ভোলাবার চেষ্টা করেছিলুম তিনি ভোলেন নি। মুগ্ধ পুরুষচিত্তের দুর্বলতার আরো অনেক প্রমাণ তিনি আরো অনেকবার পেয়েছেন, সন্দেহ নেই। আশা করলুম। আমার বেলায় এটা তিনি মনে-মনে উপভোগ করেছেন। এর চেয়ে বেড়া আর অল্প-একটু যদি ডিভোতুম, তা হলে- তা হলে কী হােত কী জানি । রাগাতেন, না রাগের ভান করতেন ? অত্যন্ত চঞ্চল মন নিয়ে চলেছি আমার বাংলো ঘরের পথে, এমন সময় আমার চোখে পড়ল দুই টুকরায় ছিন্নকরা একখানা চিঠির খাম । এটাকে জিয়লজিকাল নমুনা বলে না। তবু তুলে দেখলুম। নামটা ভাবতোষ মজুমদার আই. সি. এস. ; ঠিকানা ছাপরা, মেয়েলি হাতে লেখা । টিকিট লাগানো আছে, তাতে ডাকঘরের ছাপ নেই। যেন কুমারীর বিধা। আমার বিজ্ঞানী বুদ্ধি ; স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, এই ছেড়া চিঠির খামের মধ্যে একটা ট্র্যাজেডির ক্ষতচিহ্ন আছে। পৃথিবীর হেড়া তার থেকে তার বিপ্লবের ইতিহাস বের করা আমাদের কাজ। সেই আমার সন্ধানপটু হাত এই ছেড়া খামের রহস্য আবিষ্কার করতে সংকল্প করলে। ইতিমধ্যে ভাবছি, নিজের অন্তঃকরণের রহস্য অভূতপূর্ব। এক-একটা বিশেষ অবজায় সংস্পর্শে তার ভাবখানা কী যে একটা নতুন আকারে দানা বেঁধে দেখা দেয়, এবারে তার পরিচয়ে বিস্থিত হয়েছি। এতদিন যে-মনটা নানা কঠিন অধ্যবসায় নিয়ে শহরে শহরে জীবনের লক্ষ্য সন্ধানে ঘুরেছে, তাকে স্পষ্ট করে টিনেছিলাম। ভেবেছিলুম। সেই আমার সত্যকার স্বভাব, তার আচরণের দুৰত্ব সম্বন্ধে আমি হলপ করতে পারদুম। কিন্তু তার মধ্যে বুদ্ধিশাসনের বহির্ভূত যো-একটা মূঢ় লুকিয়ে ছিল,