পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৯২ ৷ রবীন্দ্র-রচনাবলী রেখে পড়ে রইল। এমন আশ্চর্য সৌন্দৰ্য সে কল্পনা করতে পারে না। একটা কোন বৈদ্যুত বর্ষণ প্ৰবেশ করেছে। ওর শিরার মধ্যে, চকিত হয়ে বেড়াচ্ছে অগ্নিধারায় । হাতের মুঠো শক্ত করে রেবতী কেবলই নিজেকে বলতে লাগল, কাল চায়ের নিমন্ত্রণে যাবে না। খুব শপথ করবার চেষ্টা করতে চায়, মুখ দিয়ে বেরীয় না। ব্লটিঙের উপর লিখল, যাব না, যাব না, যাব না। হঠাৎ দেখলে তার টেবিলে একটা ঘন লাল রঙের রুমাল পড়ে আছে, কোণে নাম সেলাই করা "নীলা । মুখের উপর চেপে ধরল রুমাল, গন্ধে মগজ উঠল ভরে, একটা নেশা সির সির করে ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে । নীলা আবার ঘরের মধ্যে এল। বললে, “একটা কাজ আছে ভুলে গিয়েছিলুম।” দরোয়ান রুখতে গেল। নীলা বললে, “ভয় নেই তোমার, চুরি করতে আসি নি। একটা কেবল সই চাই। জাগানী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট করব তোমাকে- তোমার নাম আছে দেশ জুড়ে ।” অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে রেবতী বললে, “ও ক্লাবের আমি তো কিছুই জানি নে ৷” “কিছুই তো জানিবার দরকার নেই। এইটুকু জানলেই হবে ব্ৰজেন্দ্রবাবু এই ক্লাবের পেট্রন । “আমি তো ব্ৰজেন্দ্রবাবুকে জানি নে ৷” “এইটুকু জানলেই হবে, মেট্ৰপলিটান ব্যাঙ্কের তিনি ডাইরেক্টর। লক্ষ্মী আমার, জাদু আমার, একটা সই বৈ তো নয়।” বলে ডান হাত দিয়ে তার কাধি ঘিরে তার হাতটা ধরে বললে, “সই করো ।” সে স্বপ্নাবিক্টের মতো সই করে দিলে । কাগজটা নিয়ে নীলা যখন মুড়ছে। দরোয়ান বললে, “এ কাগজ আমাকে দেখতে হবে।” নীলা বললে, “এ তো তুমি বুঝতে পারবে না।” দরোয়ান বললে, “দরকার নেই বোঝাবার।” বলে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললে । বললে, “দলিল বানাতে হয়। বাইরে গিয়ে বানিয়ো । এখানে নয় ।” রেবতী মনে মনে ইপি ছেড়ে বঁাচল । দরোয়ান নীলাকে বললে, “মাজি, এখন চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে আসি গে।” বলে তাকে নিয়ে গেল । কিছুক্ষণ পরে আবার ঘরে ঢুকাল পাঞ্জাবী। বললে, “চার দিকে আমি দরজা বন্ধ করে রাখি, তুমি ওকে ভিতর থেকে খুলে দিয়েছ।” এ কী সন্দেহ, কী অপমান। বার বার করে বললে, “আমি খুলি নি ।” “তবে ও কী করে ঘরে এল ।” সেও তো বটে। বিজ্ঞানী তখন সন্ধান করে বেড়াতে লাগল। ঘরে ঘরে । অবশেষে দেখলে রাস্তার ধারের একটা বড়ো জানলা ভিতর থেকে আগলি দেওয়া ছিল, কে সেই আগলটাি দিনের বেলায় এক সময়ে খুলে রেখে গেছে। T রেবতীর যে ধূর্ত বুদ্ধি আছে এতটা শ্রদ্ধা তার প্রতি দরোয়ানজির ছিল না। বোকা মানুষ,পড়াশুনো করে এই পর্যন্ত তার তাকত । অবশেষে কপাল চাপড়ে বললে, “আওরত ! এ শয়তানি বিধিদাত্ত ।” যে অল্প-একটু রাত বাকি ছিল। রেবতী নিজেকে বার বার করে বললে, চায়ের নিমন্ত্রণে যাবে না। কাক ডেকে উঠল । রেবতী চলে গেল বাড়িতে । S SR পরের দিন সময়ের একটু ব্যতিক্রম হল না। চায়ের সভায় চারটি পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই রেবতী গিয়ে হাজির। ভেবেছিল এ সভা নিভতে দুজনকে নিয়ে । ফ্যাশনেবল সাজ ওরা দখলে নেই। পরে এসেছে জামা আর ধুতি, ধোবার বাড়ি থেকে নতুন কাচিয়ে আনা, আর কাধে ঝুলছে একটা পাটকরা চাদর । এসে দেখে সভা বসেছে বাগানে। অজানা শৌখিন লোকের ভিড়। দমে গোল ওর সমস্ত মনটা, কোথাও লুকোতে পারলে বীচে। একটা কোণ নিয়ে বসবার চেষ্টা করতেই সবাই উঠে পড়ল। বললে, “আসুন আসুন। ডক্টর ভট্টাচাৰ্য, আপনার আসন এইখানে ৷”