পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\90: রবীন্দ্র-রচনাবলী প্ৰথম পর্ব জীবনের প্রবহমান ঘোলা রঙের হ-য-ব-র-লার মধ্যে হঠাৎ যেখানে গল্পটা আপন রূপ ধরে সদ্য দেখা দেয়, তার অনেক পূর্ব থেকেই নায়ক-নায়িকারা আপন পরিচয়ের সূত্র গেঁথে আসে। গল্পের গোড়ায় প্রাকৃগাজিক ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করতেই হয়। তাতে কিছু সময় নেবে। আমি যে কে, সে কথাটা পরিষ্কার করে নিই। " কিন্তু নামধাম ভাড়াতে হবে । নইলে চেনাশোনার মহলে গল্পের যথাযথ্যের জবাবদিহি সামলাতে পারব না। এ কথা সবাই বোঝে না যে ঠিকঠাক সত্য বলবার এক কায়দা, আর তার চেয়েও বেশি সত্য বলবার ভঙ্গি আলাদা । কী নাম নেব। তাই ভাবছি। রোম্যান্টিক নামকরণের দ্বারা গোড়া থেকে গল্পটাকে বসন্তরাগে পঞ্চমসুরে বাধতে চাই.নে। নবীনামাধব নামটা বোধ হয় চলনসই। ওর শামলা রঙটা মেজে ফেলে গিলটি লাগালে ওটা হতে পারত নবারুশ সেনগুপ্ত, কিন্তু খাটি শোনােত না। আমি ছিলুম। বাংলাদেশের বিপ্লবীদলের একজন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মহাকর্ষশক্তি আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল আন্ডামানের তীর-বরাবর। নানা বঁকা পথে সি. আই. ডি.-র ফাস এড়িয়ে প্রথমে চলচ্চিত্র তার পর স্থাপন তারপর আমেরিকার দেিয় পেঁচােল জাহাজ গােরকার কাজ পূর্ববঙ্গীয় দুর্জয় জেদ ছিল মজ্জায়। একদিনও ভুলি নি যে ভারতবর্ষের হাতকড়ায় উখো ঘষতে হবে দিনরাত যতদিন বেঁচে থাকি । কিন্তু এই সমুদ্রপারের কর্মপেশল হাড়মোটা প্রাণঘন দেশে থাকতে থাকতে একটা কথা নিশ্চিত বুঝেছিলুম যে, আমরা যে প্রণালীতে বিপ্লবের পালা শুরু করেছিলুম সে যেন আতশবাজিতে পটকা ছোড়ার মতো । তাতে নিজেদের পোড়াকপাল আরো পুড়িয়েছে অনেকবার, কিন্তু ফুটাে করতে পারে নি ব্রিটিশ রাজপতাকা । আগুনের উপর পতঙ্গের অন্ধ আসক্তি । যখন সদৰ্পে বাপ দিয়ে পড়ছিলুম, তখন বুঝতে পারিনি সেটাতে ইতিহাসের যজ্ঞানল জ্বালানো হচ্ছে না, জ্বালাচ্ছি নিজেদের খুব ছোটাে ছোটাে চিন্তানল । তার পরে স্বচক্ষে দেখলুম। যুরোপীয় মহাসমর । কীরকম টাকা ওড়াতে হয়। ধুলোর মতো, আর প্রাণ উড়িয়ে দেয় ধোয়ার মতো দাবানলের। মরবার জন্যে তৈরি হতে হয় সমস্ত দেশ একজোট হয়ে, মারবার জন্যে তৈরি হতে হয় দীর্ঘকাল বিজ্ঞানের দুরূহ দীক্ষা নিয়ে। এই যুগান্তরসাধিনী সর্বনাশাকে আমাদের খোড়ো ঘরের চণ্ডীমণ্ডপে প্রতিষ্ঠিত করব কোন দুরাশায়! যথোচিত সমারোহে বড়োরকমের আত্মহত্যা করবার আয়োজনও যে ঘরে নেই। ঠিক করলুম, ন্যাশনাল দুর্গের গোড়া পাকা করতে হবে, যত সময়ই লণ্ডক । বাঁচতে যদি চাই আদিম সৃষ্টির হাত দুখানায় গোটােদশেক নখ নিয়ে আঁচড মেরে লড়াই করা চলবে না। এ যুগে যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রের দিতে হবে পাল্লা । হাতাহাতি করার তালঠোকা পালোয়ানি সহজ, বিশ্বকর্মর চেলাগিরি সহজ নয়। পথ দীর্ঘ, সাধনা দুরূহ। দীক্ষা নিলুম যন্ত্রবিদ্যায়। আমেরিকায় ডেট্রয়েটে ফোর্ডের মোটর-কারখানায় কোনোমতে ভর্তি হলুম। হাত পাকাচ্ছিলুম। কিন্তু শিক্ষা এগছিল বলে মনে হয় নি। একদিন কী দুৰ্বন্ধি ঘটল, মনে হল ফোর্ডকে যদি একটুখানি আভাস দিতে যাই যে নিজের স্বার্থসিদ্ধি আমার উদ্দেশ্য নয়, আমি চাই দেশকে বাচাতে তা হলে ধনকুবের বুঝি বা খুশি হবে, এমনকি, দেবে আমার রাস্তা প্রশস্ত করে। অতি গভীরমুখে ফোর্ড বললে, “আমার নাম হেনরি ফোর্ড, পুরোনো পাকা ইংরেজি নাম। কিন্তু আমি জানি আমাদের ইংলন্ডের মামাতো ভাইরা অকেজো, ইন এফিসিয়েন্ট। তাদের আমি কেজো করে তুলব। এই আমার সংকল্প। অর্থাৎ অকেজো টাকাওয়ালকে কেজো করবে কেজো টাকাওয়ালা স্বগােত্রের লাইন বঁচিয়ে, আমরা থাকব চিরকাল কেজোদের হাতে কাদার পিণ্ড। তারা পুতুল বানাবে। এই দুঃখেই গিয়েছিলুম একদিন সোভিয়েটের দলে ভিড়তে। তারা আর যাই করুক কোনো নিরুপায় মানবজাতকে নিয়ে পুতুলনাচের অর্থকরী ব্যাবসা করে না। :