পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V9)3 রবীন্দ্র-রচনাবলী তারাই এটা গড়েছে। গড়েছে নিছক টাকার লোভে, সেটা ভালো নয় তা মানি। কিন্তু ঐ ঘুযটুকু যদি না পেত তা হলে একেবারে গড়াই হত না, এতদিন পরে আজ ওখানে পড়েছে হিসেবনিকেশের তলব ।” অচিরা বললে, “আপনি বলতে চান পায়ে তেল শুরুতে, কানমলা তার পরে ?” “নিশ্চয় । আমাদের দেশে ভিত-গাথা সবে আরম্ভ হয়েছে এখনই যদি মারা লগাই তা হলে শুরুতেই হবে শেষ, সুবিধে হবে বিদেশী বণিকদের। মানছি আজ। আমি লোভীদের ঘুষ দেওয়ার কাজ নিয়েছি, টাকাওয়ালার নায়েবি আমি করি । আজ সেলাম করছি বাদশার দরবারে এসে, কাল ওদের সিংহাসনের পায়ায় লাগাব কুড়ুল। ইতিহাসে তো এই দেখা গেছে।” অচিরা বললে, “সব বুঝলুম। কিন্তু আমি দিনের পর দিন অপেক্ষা করে আছি দেখতে, এই স্ট্রাইক মেটাতে আপনি নিজে কবে যাবেন । নিশ্চয়ই আপনাকে ডাকও পড়েছিল। কিন্তু কোন যান নি ?” চাপা গলায় বলতে চেষ্টা করলুম, “এখানে কাজ ছিল বিস্তর।” কিন্তু ফাকি দেব কী করে। আমার ব্যবহারে তো আমার কৈফিয়তের প্রমাণ হয় না। ’ কঠিন হাসি হেসে দ্রুতপদে চলে গেল অচিরা। আর চলবে না। একটা শেষ নিম্পত্তি করাই চাই। নইলে অপমানের অন্ত থাকবে না । সঁওতালী পার্বণ শেষ হয়েছে। সকালে বেড়াতে বেরিয়েছি। অচিরা সঙ্গে ছিল। উত্তরের দিকে একটা পাহাড় উঠেছে, আকাশের নীলের চেয়ে ঘন নীল। তার গায়ে গায়ে চারা শাল আর বৃদ্ধ শাল গাছে বন অন্ধকার। মাঝখান দিয়ে কাঠুরেদের পায়ে-চলার পথ। অধ্যাপক একটা অৰ্কিড ফুল বিশেষ করে পর্যবেক্ষণ করছেন, তার পকেটে সর্বদা থাকে আতস কাচ । গাছগুলোর মধ্যে অন্ধকার যেখানে ভুকুটিল হয়ে উঠেছে আর বিবি পোকা ডাকছে। তীব্র আওয়াজে, অচিরা বসিল একটা শেওলাঢাকা পাথরের উপর । পাশে ছিল মোটা জাতের বঁাশগাছ, তারই ছিটা কঞ্চির উপর আমি বসলাম । আজ সকাল থেকে অচিরার মুখে বেশি কথা ছিল না। সেইজন্যেই তার সঙ্গে আমার কথা কওয়া বাধা পাচ্ছিল । সামনের দিকে তাকিয়ে এক সময় সে আন্তে আন্তে বলে উঠল, “সামন্ত বনটা মিলে প্ৰকাণ্ড একটা বহুতঙ্গওয়ালা প্ৰাণী । গুড়ি মেরে বসে আছে শিকারি জন্তুর মতো। যেন স্থলচর অক্টোপাশি, কালো চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে । তার নিরন্তর হিপনটিজমে ক্ৰমে ক্রমে দিনে দিনে আমার মনের মধ্যে একটা ভয়ের বোঝা যেন নিরেট হয়ে উঠেছে।” আমি বললুম, “কতকটা এইরকম কথাই এই সেদিন আমার ডায়ারিতে লিখেছি।” অচিরা বলে চলল, “মনটা যেন পুরোনো ইমারত, সকল কাজের বার। নিষ্ঠুর অরণ্য যেখানে পেয়েছে তার ফাটল, চালিয়ে দিয়েছে শিকড়, সমস্ত ভিতরটাকে টানছে ভাঙনের দিকে। এই বোবা কালা মহাকায় জন্তু মনের ফাটল আবিষ্কার করতে মজবুত- আমার ভয় বেড়ে চলেছে। দাদু বলেছিলেন, “লোকালয় থেকে একান্ত দূরে থাকলে মানুষের মনঃপ্রকৃতি আসে। অবশ হয়ে, প্রবল হয়ে ওঠে তার প্রাণ-প্ৰকৃতি ।' আমি জিগগেস করলুম, “এর প্রতিকার কী।' তিনি বললেন “মানুষের মনের শক্তিকে আমরা সঙ্গে করে আনতে পারি, এই দেখে-না এনেছি তাকে আমার লাইব্রেরিতো।” দাদুর উপযুক্ত এই উত্তর । কিন্তু আপনি কী বলেন।” আমি বললুম, “আমাদের মন খোজে এমন একজন মানুষের সঙ্গ যে আমাদের সমন্ত অক্তিত্বকে সম্পূর্ণ জাগিয়ে রাখতে পারে, চেতনার বন্যা বইয়ে দেয় জনশূন্যতার মধ্যে। এ তো লাইব্রেরির সাধ্য ଜୟ୍ଯ ।” অচিরা একটু অবজ্ঞা করে বললে, “আপনি যার খোজ করছেন তেমন মানুষ পাওয়া যায় বৈকি, যদি বড় দরকার পড়ে । তারা চৈতন্যকে উসকিয়ে তোলে নিজের দিকেই, বন্যা বইয়ে দিয়ে সাধনার বঁধ ভেঙে ফেলে। এ-সমস্তই কবিদের বানানাে কথা, মোহরস দিয়ে জারানো। আপনাদের মতো