পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VSSR রবীন্দ্র-রচনাবলী মেঘলা দিনে রোজই থাকে সমান্তদিন কাজ, আর চার দিকে লোকজন। রোজই মনে হয়, সেদিনকার কাজে, সেদিনকার আলাপে সেদিনকার সব কথা দিনের শেষে বুঝি একেবারে শেষ করে দেওয়া হয়। ভিতরে কোন কথাটি যে বাকি রয়ে গেল তা বুঝে নেবার সময় পাওয়া যায় না। আজ সকালবেলা মেঘের স্তবকে স্তবকে আকাশের বুক ভেরে উঠেছে। আজও সমস্তদিনের কাজ আছে সামনে, আর লোক আছে চার দিকে । কিন্তু, আজি মনে হচ্ছে, ভিতরে যা-কিছু আছে বাইরে তা সমত শেষ করে দেওয়া যায় না । মানুষ সমুদ্র পার হল, পর্বত ডিঙিয়ে গেল, পাতালপুরীতে সিদ্ধ কোিট মণিমানিক চুরি করে আনলে, কিন্তু একজনের অন্তরের কথা আর-একজনকে চুকিয়ে দিয়ে ফেলা, এ কিছুতেই পারলে না। আজমেঘলাদিনের সকালে সেই আমার বন্দী কথাটাইমনের মধ্যে পাখা ঝাপটে মরছে। ভিতরের মানুষ বলছে, “আমার চিরদিনের সেই আর-একজনটি কোথায়, যে আমার হৃদয়ের শ্রাবণমেঘকে ফতুর করে তার সকল বৃষ্টি কেড়ে নেবে। ” আজ মেঘলা দিনের সকালে শুনতে পাচ্ছি, সেই ভিতরের কথাটা কেবলই বন্ধ দরজার শিকল নাড়ছে। ভাবছি, “কী করি । কে আছে যার ডাকে কাজের বেড়া ডিঙিয়ে এখনই আমার বাণী সুরের প্ৰদীপ হাতে বিশ্বের অভিসারে বেরিয়ে পড়বে । কে আছে যার চোখের একটি ইশারায় আমার সব ছড়ানো ব্যথা এক মুহুর্তে এক আনন্দে গাথা হবে, এক আলোতে জ্বলে উঠবে। আমার কাছে ঠিক সুরটি লাগিয়ে চাইতে পারে যে আমি তাকেই কেবল দিতে পারি। সেই আমার সর্বনেশে ভিখারি রান্তার কোন মোড়ে ।” আমার ভিতরমহলের ব্যথা আজ গেরুয়াবাসন পরেছে। পথে বাহির হতে চায়, সকল কাজের বাহিরের পথে, যে পথ একটিমাত্র সরল তারের একতারার মতো, কোন মনের মানুষের চলায় চলায় दछgछ । আশ্বিন ১৩২৬ বাণী ফোটা ফোটা বৃষ্টি হয়ে আকাশের মেঘ নামে, মাটির কাছে ধরা দেবে বলে। তেমনি কোথা থেকে মেয়েরা আসে পৃথিবীতে বাধা পড়তে । তাদের জন্য অল্প জায়গার জগৎ, অল্প মানুষেরা। ঐটুকুর মধ্যে আপনার সবটাকে ধরানো চাইআপনার সব কথা, সৱ ব্যথা, সব ভাবনা । তাই তাদের মাথায় কাপড়, হাতে কঁােকন, আঙিনায় বেড়া । মেয়ের হল সীমান্বর্গের ইন্দ্ৰাণী । কিন্তু, কোন দেবতার কৌতুকহস্যের মতো অপরিমিত চঞ্চলতা নিয়ে আমাদের পাড়ায় ঐ ছোটাে মেয়েটির জন্ম । মা তাকে রেগে বলে “দস্যি", বাপ তাকে হেসে বলে “পগলা” । সে পলাতক ঝরনার জল, শাসনের পাথর ডিঙিয়ে চলে। তার মনটি যেন বেণুবনের উপরডালের পাতা, কেবলই বিস্তুর ঝির করে কঁপিছে। R আজ দেখি, সেই দুরন্ত মেয়েটি বরাদ্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে, বাদলশেষের ইন্দ্ৰধনুট বললেই হয়। তার বড়ো বড়ো দুটি কালো চোেখ আজ অচাঞ্চল, তামালের ডালে বৃটির দিনে ডানাভেজা পাখির মতো ।