পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লিপিকা OVOO গল্পের পালা । বহুকাল কেটেছে তার বিজ্ঞানে, কারুশিল্পে ; এইবার তার শুরু হল সাহিত্য । মানুষকে তিনি গল্পে গল্পে ফুটিয়ে তুলতে লাগলেন। পশুপাখির জীবন হল আহার নিদ্রা সম্ভানপালন ; মানুষের জীবন হল গল্প। কত বেদনা, কত ঘটনা ; সুখদুঃখ রাগবিরাগ ভালেমদের কত ঘাতপ্ৰতিঘাত । ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার, একের সঙ্গে দশের, সাধনার সঙ্গে স্বভাবের, কামনার সঙ্গে ঘটনার সংঘাতে কত আবর্তন । নদী যেমন জলস্রোতের ধারা, মানুষ তেমনি গল্পের প্রবাহ। তাই পরম্পর দেখা হতেই প্রশ্ন এই, “কী হল হে, কী খবর, তার পরে ?” এই “তার পরের সঙ্গে তার পরে বোনা হয়ে পৃথিবী জুড়ে মানুষের গল্প গাথা হচ্ছে। তাকেই বলি জীবনের কাহিনী, তাকেই বলি মানুষের ইতিহাস । বিধাতার-রচা ইতিহাস আর মানুষের-রচা কাহিনী, এই দুইয়ে মিলে মানুষের সংসার। মানুষের পক্ষে কেবল-যে অশোকের গল্প, আকবরের গল্পই সত্য তা নয় ; যে রাজপুত্ৰ সাত-সমুদ্ৰ-পারে সাত-রাজার-ধন মানিকের সন্ধানে চলে সেও সত্য ; আর সেই ভক্তিবিমুগ্ধ হনুমানের সরল বীরত্বের কথাও সত্য যে হনুমান গন্ধমাদনকে উৎপাটিত করে আনতে সংশয় বোধ করে না। এই মানুষের পক্ষে আরঞ্জেব যেমন সত্য দুৰ্যোধনও তেমনি সত্য। কোনটার প্রমাণ বেশি, কোনটার প্রমাণ কম, সে হিসাবে নয় ; কেবল গল্প হিসাবে কোনটা খাটি, সেইটেই তার পক্ষে সবচেয়ে সত্য। মানুষ বিধাতার সাহিত্যলোকেই মানুষ ; সুতরাং না। সে বস্তুতে গড়া, না তত্ত্বে- অনেক চেষ্টা করে হিতৈষী কোনোমতেই এই কথা মানুষকে ভোলাতে পারলে না। অবশেষে হয়রান হয়ে হিতকথার সঙ্গে গল্পের সন্ধিস্থাপন করতে সে চেষ্টা করে, কিন্তু চিরকালের স্বভাবদোষে কিছুতে জোড়া মেলাতে পারে না । তখন গল্পও যায় কেটে, হিতকথাও পড়ে খসে, আবর্জনা জমে ওঠে । মীনু মীনু পশ্চিমে মানুষ হয়েছে। ছেলেবেলায় ইদারার ধারে তুতের গাছে লুকিয়ে ফল পাড়তে যেত ; আর আড়র খেতে যে বুড়ো মালী ঘাস নিড়োতো তার সঙ্গে ওর ছিল ভাব । বড়ো হয়ে জৌনপুরে হল ওর বিয়ে । একটি ছেলে হয়ে মারা গেল, তার পরে ডাক্তার বললে, "d9 5 कि ना-05 ।" তখন তাকে কলকাতায় নিয়ে এল । ওর অল্প বয়েস । কঁচা ফলটির মতো। ওর কঁচা প্ৰাণ পৃথিবীর বেঁটা শক্ত করে আঁকড়ে ছিল। যা-কিছু কাঁচ, যা-কিছু সবুজ, যা-কিছু সজীব, তার পরেই ওর বড়ো টান । আঙিনায় তার আট-দশ হাত জমি, সেইটুকুতে তার বাগান। এই বাগানটি ছিল যেন তার কোলের ছেলে। তারই বেড়ার পরে যে কুমকেলতা লাগিয়েছিল এইবার সেই লতায় কুঁড়ির আভাস দিতেই সে চলে এসেছে। পাড়ার সমন্ত পোষা এবং না-পোষা কুকুরের অন্ন আর আদর ওরই বাড়িতে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে যেটিকে সে ভালোবাসত তার নাক ছিল খাদা, তার নাম ছিল ভেঁাতা। তারই গলায় পর্যাবে বলে মীনু রঙিন পুতির মালা গাঁথতে বসেছিল। সেটা শেষ হল না। যার কুকুর সে বললে, “বউদিদি, এটিকে তুমি নিয়ে যাও।” মীনুর স্বামী বললে, “বড়ো হাঙ্গাম, কাজ : নেই।”