পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ONo রবীন্দ্র-রচনাবলী সে বলত, “আছে সবাই, কিন্তু আমাকে দেখে হবে কী । তারা কি আমায় চিরদিন বঁচিয়ে রাখতে পারবে ।” কাঠাকুড়নি বলত, “প্ৰাণ থাকে না বলেই তো প্ৰাণের জন্যে এত দরদ ।” তাপস বলত, “আমি খুঁজি চিরদিন বাঁচবার পথ। মানুষকে আমি অমর করব।” এই বলে সে কত কী বলে যেত ; তার নিজের সঙ্গে নিজের কথা, সে কথার মানে বুঝবে কে। ক্ষুদ্ৰ কুমন্ত না, কিন্তু আকাশে নামেদের ডাকে মািটর যেমন হয় তেমনি তার জবাফুল इ তার পরে আরো কিছু দিন যায় । তপস্বী মীেন হয়ে এল, মেয়েকে কোনো কথা বলে না। তার পরে আরো কিছু দিন যায়। তপস্বীর চোখ বুজে, এল, মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখে না। মেয়ের মনে হল, সে আর ঐ তাপসের মাঝখানে যেমন তপস্যার লক্ষ যোজন ক্রোশের দূরত্ব। হাজার হাজার বছরেও এতটা বিচ্ছেদ পাের হয়ে একটুখানি কাছে আসবার আশা নেই। তা নাই বা রইল। আশা । তবুওর কান্না আসে ; মনে মনে বলে, দিনে একবার যদি বলেন কেমন আছা তা হলে সেই কথাটুকুতে দিন কেটে যায়, এক বেলা যদি একটু ফল আর জল গ্রহণ করেন তা হলে অন্নজল ওর নিজের মুখে রোচে । V এদিকে ইন্দ্ৰলোকে খবর পীেছল, মানুষ মর্তকে লঙ্ঘন করে স্বৰ্গ পেতে চায়- এত বড়ো স্পর্ধা । ইন্দ্ৰ প্ৰকাশ্যে রাগ দেখালেন, গোপনে ভয় পেলেন । বললেন, “দৈত্য স্বৰ্গ জয় করতে চেয়েছিল বাহুবলে, তার সঙ্গে লড়াই চলেছিল ; মানুষ স্বৰ্গ নিতে চায় দুঃখের বলে, তার কাছে কি হার মানতে शंत !” মেনকাকে মহেন্দ্ৰ বললেন, “যাও, তপস্যা ভঙ্গ করোগে৷ ” মেনকা বললেন, “সুররাজ, স্বর্গের অস্ত্ৰে মর্তের মানুষকে যদি পর্যন্ত করেন তবে তাতে স্বর্গের পরাভব । মানবের মরণবাণ কি মানবীর হাতে নেই।” ইন্দ্ৰ বললেন, “সে কথা সত্য ।” ফাল্গুনমাসে দক্ষিণহাওয়ার দোল লাগতেই মর্মরিত মাধবীলতা প্ৰফুল্প হয়ে ওঠে। তেমনি ঐ কাঠকুড়ােনর উপরে একদিন নন্দনবনের হাওয়া এসে লাগল, আর তার দেহ,মন একটা কোন উৎসুক মাধুর্যের উন্মেষে উন্মেষে ব্যথিত হয়ে উঠল। তার মনের ভাবনাগুলি চাকছাড়া মৌমাছির মতো উড়তে লাগল, কোথা তারা মধুগন্ধ পেয়েছে। ঠিক সেই সময়ে সাধনার একটা পালা শেষ হল। এইবার তাকে যেতে হবে নির্জন গিরিগুহায় । তাই সে চোখ মেলল । সামনে দেখে সেই কাঠকুড়নি মেয়েটি ধোপায় পরেছে একটি অশোকের মাজরী, আর তার গায়ের কাপড়খনি কুসুভফুলে রঙ করা। যেন তাকে চেনা যায় অথচ চেনা যায় না । যেন সে এমন একটি জানা সুর যার পদগুলি মনে পড়ছে না । যেন সে এমন একটি ছবি যা কেবল রেখায় টানা ছিল, চিত্রকর কোন খেয়ালে কখন এক সময়ে তাতে রঙ লাগিয়েছে। । তাপস আসন ছেড়ে উঠল। বললে, “আমি দূর দেশে যাব।” কাঠাকুড়ুনি জিজ্ঞাসা করলে, “কেন, প্ৰভু।” তপৰী বললে, “তপস্যা সম্পূৰ্ণ করবার জন্যে ।” কাঠফুভূনিহত জোড় করে বললে, “দর্শনের পুণ্য হতে আমাকে কেন বঞ্চিত করবে। ” তাপী আবার আসনে বসিল, অনেকক্ষণ ভাবল, আর কিছু বলল না ।