পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SAV রবীন্দ্র-রচনাবলী “একবার তোমার চারিদিকে তাকিয়ে দেখো। চেয়ে দেখি, শার আছে কিন্তু লক্ষ্য করবার কিছুই নেই। স্বর্গের লক্ষ্য চলে গেছে । বৃহস্পতি । কেন এমন হল তার কারণ তো জানা চাই। ইন্দ্র। যে মাটির থেকে রস টেনে স্বৰ্গ আপনার ফুল ফুটিয়েছিল। সেই মাটির সঙ্গে তার সম্বন্ধ ছিন্ন SG (A বৃহস্পতি । মাটি আপনি কাকে বলছেন। ইন্দ্র। পৃথিবীকে । মনে তো আছে, একদিন মানুষ স্বর্গে এসে দেবতার কাজে যোগ দিয়েছে এবং দেবতা পৃথিবীতে নেমে মানুষের যুদ্ধে অন্ত্র ধরেছে। তখন স্বর্গমর্ত উভয়েই সত্য হয়ে উঠেছিল, তাই সেই যুগকে সত্যযুগ বলত। সেই পৃথিবীর সঙ্গে যোগ না থাকলে স্বৰ্গ আপনার অমৃতে আপনি কি (No. 99 | কার্তিকেয়। আর, পৃথিবীও যে যায়, দেবরাজ। মানুষ এমনি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যাচ্ছে যে, সে আপনার শৌর্যকে আর বিশ্বাস করে না, কেবল বস্তুর উপরেই তার ভরসা। বস্তু নিয়ে মারামারি কাটাকাটি পড়ে গেছে। স্বর্গের টান যে ছিন্ন হয়েছে, তাই আত্মা বস্তু ভেদ করে আলোকের দিকে উঠতে পারছে না। বৃহস্পতি । এখন উদ্ধারের উপায় কী । ইন্দ্র । পৃথিবীর সঙ্গে স্বর্গের আবার যোগসাধন করতে হবে। বৃহস্পতি । কিন্তু, দেবতারা যে পথ দিয়ে পৃথিবীতে যেতেন, অনেক দিন হল, সে পথের চিহ্ন লোপ হয়ে গেছে। আমি মনে করেছিলুম, ভালোই হয়েছে। ভেবেছিলুম, এইবার প্রমাণ হয়ে যাবে, স্বৰ্গ নিরপেক্ষ, নিরবলম্ব, আপনাতেই আপনি সম্পূর্ণ। ইন্দ্র। একদিন সকলেরই সেই বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীর প্রেমেই স্বৰ্গ ধাচে, নইলে স্বৰ্গ শুকিয়ে যায়। অমৃতের অভিমানে সেই কথা ভুলেছিলুম বলেই পৃথিবীতে দেবতার যাবার পথের চিহ্ন লোপ পেয়েছিল । কাৰ্তিকেয়। দৈত্যদের পরাভাবের পর থেকে আমরা আটঘটি বেঁধে স্বৰ্গকে সুরক্ষিত করে তুলেছি। তার পর থেকে স্বগের ঐশ্বৰ্য স্বগের মধ্যেই জমে আসছে ; বাহিরে তার আর প্রয়োগ নেই, তার আর ক্ষয় নেই । যুগ যুগ হতে অব্যাঘাতে তার এতই উন্নতি হয়ে এসেছে যে, বাহিরের অন্য সমস্ত কিছু থেকে স্বৰ্গ বহু দূরে চলে গেছে। স্বৰ্গ তাই আজ একলা । * ইন্দ্র । উন্নতিই হোক আর দুৰ্গতিই হােক, যাতেই চার দিকের সঙ্গে বিচ্ছেদ আনে তাতেই ব্যর্থতা আনে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ যখন সুদূরে চলে যায়। তখন তার মহত্ত্ব নিরর্থক হয়ে আপনাকে আপনি ভারগ্রন্ত করে মাত্র । স্বগের আলো আজ। আপনার মাটির প্রদীপের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলেয়ার আলো হয়ে উঠেছে, লোকালয়ের আয়ত্তের অতীত হয়ে সে নিজেরও আয়ত্তের অতীত হয়েছে ; নির্বাপণের শান্তির চেয়ে তার এই শান্তি গুরুতর। দেবালোক আপনাকে অতি বিশুদ্ধ রাখতে গিয়ে আপন শুচিতার উচ্চ প্রাচীরে নিজেকে বন্দী করেছে, সেই দুৰ্গম প্রাচীর ভেঙে গঙ্গার ধারার মতো মলিন মর্তের মধ্যে তাকে প্রবাহিত করে দিয়ে তবে তার বন্ধনমোচন হবে । তার সেই স্বাতন্ত্র্যের বেষ্টন বিদীর্ণ করবার জন্যেই আমার মন আজ এমন বিচলিত হয়ে উঠেছে। স্বৰ্গকে আমি ঘিরতে দেব না, বৃহস্পতি ; মলিনের সঙ্গে, পতিতের সঙ্গে, অজ্ঞানীর সঙ্গে, দুঃখীর সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দিতে হবে। বৃহস্পতি। তা হলে আপনি কী করতে চান। ইন্দ্র। আমি পৃথিবীতে যাব। বৃহস্পতি । সেই যাবার পথটাই বন্ধ, সেই নিয়েই তো দুঃখ । ইন্দ্র। দেবতার স্বরূপে সেখানে আর যেতে পারব না, মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করব । নক্ষত্র যেমন খসে পড়ে। তার আকাশের আলো আকাশে নিবিয়ে দিয়ে, মাটি হয়ে মাটিকে আলিঙ্গন করে, আমি তেমনি করে পৃথিবীতে যাব।