পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q 899) হলে উঠেছে কলরব, উচুনিচু ডাঙায় ঝাপসা দেখাচ্ছে দলবাধা গাছ। সমস্তটার পিছনে খোলা আকাশ ; সেই আকাশে একটা সুদূরতা, মনে হচ্ছে যেন অনেক দূরের ও-পার থেকে একটা ঘণ্টার ধ্বনি ক্ষীণতম হয়ে গেছে বাতাসে, যেন রোদদূরে মিশিয়ে দিয়েছে তার কথাটাকে ; বেলা যায়। তোমার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল, একখানা গাছ হওয়ার চেয়ে নদী বন আকাশ নিয়ে একখানা সমগ্র ভূদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কল্পনা তোমার কাছে অনেক বেশি সৃষ্টিছাড়া বোধ হল। সুকুমার বললে, গাছপালা নদী সবটার উপরে তুমি ছড়িয়ে মিলিয়ে গেছ মনে করতে আমার ভারি মজা লাগছে। আচ্ছা, সত্যযুগ কি কোনোদিন আসবে। যতদিন না আসে ততদিন ছবি আছে, কবিতা আছে। আপনাকে ভুলে গিয়ে আর-কিছু হয়ে যাবার ঐ একটা বড়ো রান্ত । সুকুমার বললে, তুমি যেটা বললে ওটা কি ছবিতে এঁকেছি। ই, এঁকেছি। আমিও একটা আঁকিব । সুকুমারের স্পর্ধার কথা শুনে তুমি বলে উঠলে, পারবে না কি তুমি আঁকতে । আমি বললুম, ঠিক পারবে। আঁকা হয়ে গেলে ভাই, তোমারটা আমি নেব, আমারটা তোমাকে (WK সেদিন এই পর্যন্ত হল আমাদের আলাপ । এইবার আমাদের সেদিনকার আসরের শেষ কথাটা বলে নিই। তুমি চলে গেলে তোমার পায়রাকে ধান খাওয়াতে । সুকুমার তখনো বসে বসে কী ভাবতে লাগল। আমি তাকে বললুম, তুমি কী ভাবছি ब्द ? সুকুমার বললে, বলে দেখি । তুমি ভেবে দেখছ, আরো কী হয়ে যেতে পারলে ভালো হয়- হয়তো প্রথম-মেঘকরা আষাঢ়ের বৃষ্টি-ভেজা আকাশ, হয়তো পুজোর দুটিতে ঘরমুখো পাল-তোলা পালিনীেকেখানি । এই উপলক্ষে আমি তোমাকে আমার জীবনের একটা কথা বলি। তুমি জানা ধীরুকে আমি কত ভালোবাসতুম | হঠাৎ টেলিগ্রামে খবর পেলুম তার টাইফয়েড, সেই বিকেলেই চলে গেলুম মুন্সিগঞ্জে তাদের বাড়িতে । সাত দিন, সাত রাত কাটল। সেদিন ছিল অত্যন্ত গরম, রৌদ্র প্রখর । দূরে একটা কুকুর করুশ সুরে আঁর্তনাদ করে উঠছিল ; শুনে মন খারাপ হয়ে যায়। বিকেলে রোদ পড়ে আসছে, পশ্চিম দিক থেকে মুরগাছের ছায়া পড়েছে। বারান্দার উপরে। পাড়ার গয়ালানি এসে জিগেস করলে, তোমাদের থাকাবাবু কেমন আছেগা। আমি বললুম, মাথার কষ্ট, গা-জ্বালা আজ কমেছে। যারা সেবা করছিল। তারা আজ কেউ কেউ ছুটি নেবার অবকাশ পেলে । দুজন ডাক্তার রুগি দেখে বেরিয়ে এসে ফিসফিস ক্টরে কী পরামর্শ করলে ; বুঝলেম, আশার লক্ষণ নয়। চুপ করে বসে রইলুম ; মনে হল, কী হবে 3ন | সায়াহের ছায়া ঘনিয়ে এল । দেখা গেল সামনের মহানিমগাছের মাথার উপরে সন্ধ্যাতারা দেখা দিয়েছে। দূরের রাস্তায় পাট-বোঝাই গোরুর গাড়ির শব্দ আর শোনা যায় না। সমস্ত আকাশটা যেন ৰিমঝিম করছে। কী জানি কেন মনে মনে বলছি, পশ্চিম-আকাশ থেকে ঐ আসছে রক্রিরূপিণী শক্তি, স্নিগ্ধ, কালো, অন্ধ। প্রতিদিনই তো আসে। কিন্তু আজ এল বিশেষ একটি মূর্তি নিয়ে, স্পর্শ নিয়ে। চৌধ বুজে সেই ধীরে-চলে-আসা রাত্রির আবির্ভাব আমার সমন্ত অঙ্গকে মনকে যেন আবৃত করে লে। মনে মনে বললুম, ওগো শক্তি, ওগো রাত্রি, তুমি আমার দিদি, আমার অনাদি কালের দিদি। দীন-অবসানের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে টেনে নাও তোমার বুকের কাছে আমার ধীরুভাইকে ; তার সকল স্বালা যাক জুড়িয়ে একেবারে - দুই পহুর পেরিয়ে গেল ; একটা কায়ার ধ্বনি উঠল রোগীর শয়রের কাছ থেকে; নিন্তব্ধ রাস্তা বেয়ে গেল চলে ডাক্তারের গাড়ি তার ঘরে ফিরে। সেদিন আমার *মতা-মন-ভরা একটি রাত্রির রূপ দেখেছি ; আমি তাতে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলুম, পৃথিবী যেমন তার