পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

QQ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বাকিটা আর বলা হল না। মনে মনে তখন রাজপুতনা থেকে গল্প তলপ করতে আরম্ভ করেছি। খানিকটা কাশলুম। একবার বললুম, রোসো, একবার একটুখানি দেখে আসি, কে যেন এল। কেউ আসে নি । শেষকালে বসতে হল । যমদূতগুলো মোটের উপরে ইদা। একটু নড়তে গেলেই ধুপ ধাপ করে শব্দ করে, আর তাদের শেল শূল ছুরিছোরাগুলো ঝনঝনিয়ে ওঠে। সেদিন কিন্তু একেবারে নিঃশব্দ। সন্ধ্যা হয়েছে, পথিক চলেছেন গোরুর গাড়িতে করে। পরদিন সকালে রাজমহলে পৌঁছলে নীেকো নিয়ে তিনি যাত্রা করবেন পশ্চিমে । তিনি রাজপুত, তার নাম অরিজিৎ সিংহ। বাংলাদেশে ছোটো কোনো রাজার ঘরে সেনাপতির কাজ করতেন । ছুটি নিয়ে চলেছেন রাজপুতনায় । রাত্রি হয়ে এসেছে। গাড়িতে বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ এক সময় জেগে উঠে দেখলেন, গাড়ি চলেছে বনের মধ্যে । গাড়োয়ানকে বললেন, ঘাটের রাস্তা ছেড়ে এখানে কেন । গাড়োয়ান বললে, আমাকে চিনলেই বুঝবেন কেন । তার পাগড়িটা অনেকখানি আড় করে পরা ছিল। সোজা করে পরতেই অরিজিৎ বললেন, চিনেছি। ডাকাতের সর্দার পরাক্রমসিংহের চর। তুমি । অনেকবার তোমার হাতে পড়েছিলুম, এড়িয়ে এসেছি । সে বললে, ঠিক ঠাওরেছেন, এবার এড়াতে পারছেন না । চলুন আমার মনিবের কাছে । অরিজিৎ বললেন, উপায় নেই, যেতেই হবে । কিন্তু, তোমাদের ইচ্ছে পূৰ্ণ হবে না। গাড়ি চলল বনের মধ্যে। এর আগের কথাটা এবার খুলে বলা যাক । অরিজিৎ বড়ো ঘরের ছেলে । মোগল সম্রাট তার রাজ্য নিলে কেড়ে, তিনি এলেন বাংলাদেশে পালিয়ে । এখান থেকে তৈরি হয়ে একদিন তার রাজ্য ফিরে নেবেন, এই ছিল তার পণ । এ দিকে বিবাহের বয়স হয়েছে ; অরিজিতের সঙ্গে বিবাহ হয়, এই ছিল তার চেষ্টা । কিন্তু, জাতিতে তিনি অরিজিতের সমান দরের ছিলেন না, তার ঘরের মেয়েকে বিবাহ করতে অরিজিৎ রাজি নন । রাত্রি ভোর হয়ে এসেছে । তাকে পরাক্রমের দরবারে এনে দাড় করালে পরাক্রম বললেন, ভালো সময়েই এসেছ, বিয়ের লগ্ন পড়বে। আর দু দিন পরে । তোমার জন্য বরসজ্জা সব তৈরি । অরিজিৎ বললেন, অন্যায় করবেন না। সকলেই জানে, আপনার গুষ্টিতে মুসলমান রক্তের মিশন ঘটেছে । পরাক্রম বললেন, কথাটা সত্য হতেও পারে, সেইজন্যেই তোমার মতো উচ্চ কুলের রক্ত মিশল করে আমার বংশের রক্ত শুধরে নেবার জন্যে এতদিন চেষ্টা করেছি। আজ সুযোগ এল । তোমার মানহানি করব না । বন্দী করে রাখতে চাই নে, ছাড়া থাকবে । একটা কথা মনে রেখো, এই বন থেকে বেরোবার রাস্তা না জানলে কারোর সাধ্যি নেই। এখান থেকে পালায় । মিছে চেষ্টা কোরো না, আর য ইচ্ছা করতে পার । রাত্রি অনেক হয়েছে। অরিজিতের ঘুম নেই, বসেছেন এসে কাশিনী নদীর ঘাটে বটগাছের তলায় এমন সময় একটি মেয়ে, মুখ ঘোমটায় ঢাকা, তাকে এসে বললে, আমার প্রণাম নিন। আমি এখানক? সর্দারের মেয়ে। আমার নাম রঙিনকুমারী। আমাকে সবাই চন্দনী বলে ডাকে। আপনার সঙ্গে পিতক্তি আমার বিবাহ অনেক দিন থেকে ইচ্ছা করেছেন । শুনলেম, আপনি রাজি হচ্ছেন না । কারণ কী বলুন আমাকে । আপনি কি মনে করেন। আমি অস্পশ্য। অরিজিৎ বললেন, কোনো মেয়ে কখনো অস্পৃশ্য হয় না, শাস্ত্রে বলেছে। তবে কি আমাকে দেখতে ভালো নয় বলে আপনার ধারণা । তাও নয়, আপনার রূপের সুনাম আমি দূর থেকে শুনেছি। তবে আপনি কেন কথা দিচ্ছেন না ।