পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

GS8 রবীন্দ্র-রচনাবলী পাওয়া গেল। কিন্তু মানুষের বুদ্ধির দীেড় তার বোধের চেয়ে আরো অনেক বেশি, জগতের সকল দৌড়ের সঙ্গেই সে পাল্লা দেবার স্পর্ধ রাখে। সে এই প্রকাণ্ড জগতের প্রকাণ্ড মাপের খবর জানতে বেরল, অনুভূতির ছেলেভুলানাে গুজব দিলে বাতিল করে। নকোটি ত্ৰিশ লক্ষ মাইলকে আমরা কোনোমতেই অনুভব করতে পারি নে, কিন্তু বুদ্ধি হার মানলে না, হিসেব কাষতে বসল। বাইরের বিশ্বলোকটার কথা থাক, আমরা যে পৃথিবীতে আছি, তার চেয়ে কাছে তো আর কিছুই নেই, তবু এর সমস্তটাকে এক করে দেখা আমাদের বোধের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু একটি ছােটাে গ্লোবে যদি তার ম্যাপ আঁকা দেখি, তা হলে পৃথিবীর সমগ্রটাকে জানার একটুখানি গোড়াপত্তন হয়। আয়তন হিসাবে গ্লোবটি পৃথিবীর অনেক-হাজার ভাগের একভাগমাত্র । আমাদের অন্য-সব বোধ বাদ দিয়ে কেবলমাত্র দৃষ্টিবােধের আঁচড়কাটা পরিচয় এতে আছে। বিস্তারিত বিবরণ হিসাবে, এ একেবারে ফঁাকা । বেশি দেখবার শক্তি আমাদের নেই বলেই ছোটো করেই দেখাতে হল । প্রতিরোত্রে বিশ্বকে এই-যে ছোটো করেই দেখানো হয়েছে সেও আমাদের মাথার উপরকার আকাশের গ্লোবে | দৃষ্টিবোধ ছাড়া অন্য কোনো বোধ এর মধ্যে জায়গা পায় না । যা চিন্তা করতে মন অভিভূত হয়ে যায় এত বড়ো জিনিসকে দিক-সীমানায় বদ্ধ এই আকাশটুকুর মধ্যে আমাদের কাছে ধরা হল । কতই ছোটাে করে ধরা হয়েছে তার একটুখানি আন্দাজ পেতে হলে সূর্যের দৃষ্টান্ত মনে আনতে হবে । স্বভাবতই আমরা যতী-কিছু বড়ো জিনিসকে জানি বা মনে আনতে পারি তার মধ্যে সব চেয়ে বড়ো এই পৃথিবী। একে আমরা অংশ অংশ করেই দেখতে পারি। একসঙ্গে সবটার প্রকৃত ধারণা আমাদের বোধের পক্ষে অসম্ভব। অথচ সূর্য এই পৃথিবীর চেয়ে তেরো লক্ষ গুণ বড়ো। এতবড়ো সূর্য আকাশের একটা ধারে আমাদের কােছ দেখা দিয়েছে একটি সোনার থালার মতো। সূর্যের ভিতরকার সমস্ত তুমুল তোলপাড়ের যখন খবর পাই আর তার পরে যখন দেখি ভোরবেলায় আমাদের আমবাগানের পিছন থেকে সোনার গোলকটি ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছে, জীবজন্তু গাছপালা আনন্দিত হয়ে উঠছে, তখন মনে ভাবি আমাদের কিরকম ভুলিয়ে রাখা হয়েছে ; আমাদের বলে দিয়েছে, “তোমাদের জীবনের কাজে এর বেশি জানিবার কোনো দরকার নেই।' না ভোলালেই ব: বঁচতুম কী করে। ঐ সূর্য আপন বিরাট স্বরূপে যা, সে যদি আমাদের অনুভূতির অল্পমাত্রও কাছে আসত তা হলে তো আমরা মুহুর্তেই লোপ পেয়ে যৌতুম। এই তো গেল। সূর্য। এই সূর্যের চেয়ে আরো অনেক গুণ বড়ো আছে আরো অনেক অনেক নক্ষত্র । তাদের দেখছি কতকগুলি আলোর ফুটকির মতো । যে-দূরত্বের মধ্যে এই সব নক্ষত্র ছড়ানো, ভেবে তার কিনারা পাওয়া যায় না । বিশ্বজগতের বাসা যে আকাশটাতে।সেটা যে কত বড়ো সে কথা আর-একদিক থেকে ভেবে দেখা যেতে পারে } আমাদের তাপবোধে পৃথিবীর বাইরে থেকে একটা খুব বড়ো খবর খুব জোরের সঙ্গে এসে পেঁচাচ্ছে, সে হচ্ছে রৌদ্রের উত্তাপ। এ খবরটা নকোটি ত্ৰিশ লক্ষ মাইল দূরের। কিন্তু ঐ তো আকাশে আকাশে আছে বহুকোটি নক্ষত্র, তাদের মধ্যে কোনো-কোনোটি সূর্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি উত্তপ্ত । কিন্তু আমাদের ভাগগুণে তাদের সম্মিলিত গরম পথেই এতটা মারা গেল যে বিশ্বজোড়া অগ্নিকাণ্ডে আমাদের আকাশটা দুঃসহ হল না। কত দূরের এই পথ, কত প্ৰকাণ্ড এই আকাশ । তাপের-অনুভূতিতে-স্পর্শ করা:নকোটি মাইল তার কাছে তুচ্ছ। বড়ো যজ্ঞের রান্নাঘরে যে চুলি জুলছে তার কাছে বাসা আরামের নয়, কিন্তু বেলা দশটার কাছাকাছি শহরের সমস্ত রান্নাঘরে যে আগুন জ্বলে বড়ো আকাশে তা ছড়িয়ে যায় বলেই শহরে বাস করতে পারি। নক্ষত্ৰলোকের ব্যাপারটাওঁ সেইরকম । সেখানকার আগুনের ঘটা যতই প্ৰচণ্ড হোক, তার চার দিকের আকাশটা আরো অনেক sers' এই বিরাট দূরত্ব থেকে নক্ষত্রদের অত্তিত্বের খবর এনে দিচ্ছে কিসে। সহজ উত্তর হচ্ছে আলো ! কিন্তু আলো যে চুপচাপ বসে খবর আউড়িয়ে যায় না, আলো যে ডাকের পেয়াদার মতো খবর পিঠে করে নিয়ে দৌড়ে চলে, বিজ্ঞানের এই একটা মন্ত আবিষ্কার। চলা বলতে সামান্য চলা নয়, এমন চল: