পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(2 SRV রবীন্দ্র-রচনাবলী কোনোটা দেখা যায়, কোনোটা স্পর্শে বোঝা যায় ; কোনোটাকে স্পষ্ট আলোরূপে জানি আবার সঙ্গে সঙ্গেই তাপরাপেও বুঝি ; কোনোটাকে দেখাও যায় না, স্পর্শেও পাওয়া যায় না। আমাদের কাছে প্রকাশিত অপ্রকাশিত আলোতরঙ্গের ভিড়কে যদি এক নাম দিতে হয়, তবে তাকে তেজ বলা যেতে পারে। বিশ্বসৃষ্টির আদি-অন্তে-মধ্যে প্রকাশ্যে আছে বা লুকিয়ে আছে বিভিন্ন অবস্থায় এই তেজের কাপন। পাথর হােক লোহা হােক বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় তাদের মধ্যে কোনো নড়াচড়া নেই। তারা যেন স্থিরত্বের আদর্শস্থল। কিন্তু এ কথা প্রমাণ হয়ে গেছে যে তাদের অণু,পরমাণু, অর্থাৎ অতি সূক্ষ্ম পদার্থ, যাদের দেখতে পাই নে "অথচ যাদের মিলিয়ে নিয়ে এরা আগাগোড়া তৈরি, তারা সকল সময়েই ভিতরে ভিতরে কঁপিছে । ঠাণ্ডা যখন থাকে তখনো কঁপিছে, আর কঁপুনি যখন আরো চড়ে ওঠে তখন গরম হয়ে বাইরে থেকেই ধরা পড়ে আমাদের বোধশক্তিতে । আগুনে পোড়ালে লোহার পরমাণুর্কাপতে কঁাপিতে এত বেশি অস্থির হয়ে ওঠে যে তার উত্তেজনা আর লুকানো থাকে না। তখন কাপনের ঢেউ আমাদের শরীরের স্পর্শনাড়ীকে ঘা মেরে তার মধ্য দিয়ে যে খবরটা চালিয়ে দেয় তাকে বলি গরম । বস্তুত গরমটা আমাদের মারে । আলো মারে চোখে, গরম মারে গায়ে । ছেলেবেলায় যখন একদিন মাস্টারমশায় দেখিয়ে দিলেন লোহার টুকরো আগুনে তাঁতিয়ে প্রথমে হয় গরম, তার পরে হয় লাল টকটকে, তার পরে হয় সাদা জ্বলজ্বলে, বেশ মনে আছে তখন আমাকে এই কথা নিয়ে ভাবিয়েছিল যে, আগুন তো কোনো-একটা দ্রব্য নয়। যেটা লোহার সঙ্গে বাইরে থেকে মিশিয়ে লোহকে দিয়ে এমনতরো চেহারা বদল করাতে পারে । তার পরে আজ শুনছি। আরো তাপ দিলে এই লোহাটা গ্যাস হয়ে যাবে। এ-সমস্তই জাদুকর তাপের কাণ্ড, সৃষ্টির আরম্ভ থেকে আজ পর্যন্ত be সূর্যের আলো সাদা। এই সাদা রঙে মিলিয়ে আছে সাতটা বিভিন্ন রঙের আলো। যেন সাতরঙের রশ্মির পেখম, গুটিয়ে ফেললে দেখায় সাদা, ছড়িয়ে ফেললে দেখায় সাতরঙ । সেকালে ছিল ঝাড়লন্ঠন, বিজলিবাতির তাড়ায় তারা হয়েছে দেশছাড়া। এই ঝাড়ের গায়ে দুলত তিনপিঠওয়ালা কঁচের পরিকলা। এইরকম তিনপিঠওয়ালা কঁাচের গুণ এই যে, ওর ভিতর দিয়ে রোদন্দুর এলে তার থেকে সাত রঙের আলো ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে। পরে পরে রঙ বিছানো হয় ; বেগনি (Violet), অতিনীল (Indigo), Rei (Blue), Sef (Green), 2IC (Yellow), নারাঙি (Orange) var লাল (Red)। এই সাতটা রঙ চোখে দেখা যায়। কিন্তু এদের দুই প্রান্তের বাইরে তেজের আরো অনেক ছোটাে-বড়ো ঢেউ আছে, তারা আমাদের সহজ চেতনায় ধরা দেয় না । সেই জাতের যে ঢেউ বেগনি রঙের পরের পারে তাকে বলে ultra-violet light, সহজ ভাষায় বলা যাক বেগনি-পারের আলো । আর যে আলো লালের এলাকায় এসে পৌঁছয় নি, রয়েছে তার আগের পারে তাকে বলে infra-red light, আমরা বলতে পার লাল-উজানি আলো। স্যার উইলিয়াম হার্শাল ছিলেন এক মন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনপিঠওয়ালা কাচের মধ্য দিয়ে তিনি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন আলোর সাতরঙ ছটা । কালেরঙ-করা তাপ-মাপের নল নিয়ে এক-একটা রঙের কাছে ধরে দেখলেন । লাল রঙের দিকে উত্তাপ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। লাল পেরিয়ে নলটিকে নিয়ে গেলেন বেরঙা অন্ধকারে, সেখানেও গরম থামতে চায় না । বোঝা গেল। আরো আলো আছে ঐ অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে । তার পরে এলেন এক জর্মন রসায়নী । একটা ফোটোগ্রাফির প্লেট নিয়ে পরীক্ষায় লাগলেন । এই প্লেটে লাল থেকে বেগনি পর্যন্ত সাতটা রঙের সাড়া পাওয়া গেল । শেষে বেগনি পেরিয়ে চললেন অন্ধকারে, সেখানে চোখে যা ধরা দেয় না প্লেটে তা ধরা পড়ল। দেখা গেল আলোর উত্তাপটা লাল রঙের দিকে, আর রাসায়নিক ক্রিয়া বেগনি-পারের দিকে । এক কালে মনে হয়েছিল। অ-দেখারা রঙিন দলেরই পাশ্বচর, অন্ধকারে পড়ে গেছে । যত এগোতে লাগল। গুপ্ত আলোর সন্ধান, ততই সাতরঙ দলেরই আসন হল খাটাে । বিজ্ঞানের জরীপে আলোর সীমানা আজ সাতরঙ রাজার দেশ ছাড়িয়ে গেছে শতগুণ । লাল-উজানি আলোর দিকে ক্রমে আজ দেখা দিল যে ঢেউ সেই ঢেউ বেয়ে চলে আকাশবাণী, যাকে বলে রেডিয়োবার্তা ; বেগনি-পারের দিকে প্রকাশ পেল বিখ্যাত র্যান্টগেন আলো,