পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিশ্বপরিচয় G. So আজকাল ইলেকট্রিসিটি শব্দটা খুব চলতি-ইলেকট্রিক বাতি, ইলেকট্রিকর্মশাল, ইলেকট্রিক পাখা এমন আরো কত কী। সকলেরই জানা আছে। ওটা একরকমের তেজ । এও সবাই জানে মেঘের মধ্যে থেকে আকাশে যা চমক দেয় সেই বিদ্যুৎও ইলেকট্রিসিটি ছাড়া আর কিছু নয়। এই বিদ্যুৎই পৃথিবীতে আমাদের কাছে সব চেয়ে প্রবল প্ৰতাপে ইলেকট্রিসিটিকে, আলোয় এবং গর্জনে ঘোষণা করে । গায়ে লাগলে সাংঘাতিক হয়ে ওঠে । ইলেকট্রিসিটি শব্দটাকে আমরা বাংলায় বলব বৈদ্যুত । এই বৈদ্যুত আছে দুই জাতের । বিজ্ঞানীরা এক জাতের নাম দিয়েছেন। পজিটিভ, আর-এক জাতের নাম নেগেটিভ। তৰ্জমা করলে দাঁড়ায় হী-ধমী আর না-ধমী । এদের মেজাজ পরস্পরের উলটাে, এই বিপরীতকে মিলিয়ে দিয়েছে সমস্ত যা-কিছু। অথচ পজিটিভের প্রতি পজিটিভের, নেগেটিভের প্রতি নেগেটিভের একটা স্বভাবগত বিরুদ্ধতা আছে, এদের টানটা বিপরীত পক্ষের দিকে । এই দুই জাতের অতি সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিকণা জোট বেঁধেছে। পরমাণুতে । এই দুই পক্ষকে নিয়ে প্রত্যেক পরমাণু যেন গ্রহে সূর্যে মিলন-বাধা । সৌরমণ্ডলের মতো। সূর্য যেমন সীেরলোকের কেন্দ্রে থেকে টানের লাগামে ঘোরাচ্ছে পৃথিবীকে, পজিটিভ বৈদ্যুতিকণা তেমনি পরমাণুর কেন্দ্রে থেকে টান দিচ্ছে নেগেটিভ কণাগুলোকে, আর তারা সার্কসের ঘোড়ার মতো লাগামধারী পজিটিভের চার দিকে ¥g(ጀ | পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চার দিকে, নয়। কোটি মাইলের দূরত্ব রক্ষা করে। আয়তনের তুলনায় অতিপরমাণুদের কক্ষপথের দূরত্ব অনুপাতে তার চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। পরমাণু যে অণুতম আকাশ অধিকার করে আছে তার মধ্যেও দূরত্বের প্রভূত কম-বেশি আছে। ইতিপূর্বে নক্ষত্ৰলোকে বৃহত্ত্বের ও পরস্পর-দূরত্বের অতি প্ৰকাণ্ডতার কথা বলেছি, কিন্তু অতি ছোটােকেও বলা যেতে পারে অতি প্ৰকাণ্ড ছোটাে । বৃহৎ প্ৰকাণ্ডতার সীমাকে সংখ্যাচিহ্ন দিয়ে ঘের দিতে গেলে যেমন একের পিছনে বিশ-পচিশটা অঙ্কপাত করতে হয় ক্ষুদ্রতম প্ৰকাণ্ডতা সম্বন্ধে সেই একই কথা । তারও সংখ্যার ফৌজ লম্বা লাইন জুড়ে দাঁড়ায়। পরমাণুর অতি সূক্ষ্ম আকাশে যে দূরত্ব বঁচিয়ে অতিপরিমাণুর চলাফেরা করে তার উপমা উপলক্ষে একজন বিখ্যাত জ্যোতিষী বলেছেন, হাওড়া স্টেশনের মতো মন্ত একটা স্টেশন থেকে অন্য সবা-কিছু জিনিস সরিয়ে দিয়ে কেবল গোটা পাঁচ-ছয় বোলতা ছেড়ে দিলে তবে তারই সঙ্গে তুলনা হতে পারে পরমাণুর আকাশস্থিত অতিপারমাণুদের । কিন্তু এই ব্যাপক শূন্যের মধ্যে দূরবতী কয়েকটি চঞ্চল পদার্থকে আটকে রাখবার জন্যে পরমাণুর কেন্দ্রবস্তুর প্রায় সমস্ত ভার সমস্ত শক্তি কাজ করছে। এ না হলে পরমাণুজগৎ ছারখার হয়ে যেত, আর পরমাণু দিয়ে গড়া বিশ্বজগতের অস্তিত্ব থাকত না । পদার্থের মধ্যে অণুগুলি পরস্পর কাছাকাছি আছে একটা টানের শক্তিতে। তবু সোনার মতো নিরেট জিনিসের অণুরও মাঝে মাঝে ফাক আছে। সংখ্যা দিয়ে সেই অতি সূক্ষ্ম ফাকের পরিমাণ জানাতে চাই নে, তাতে মন পীড়িত হবে। প্রশ্ন ওঠে একটুও ফাক থাকে কেন, গ্যাস থাকে কেন, কেন থাকে তরল পদার্থ। এর একই জাতের প্রশ্ন হচ্ছে পৃথিবী কেন সূর্যের গায়ে গিয়ে ঐটে যায় না। সমস্ত বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড একটা পিণ্ডে তাল পাকিয়ে যায় না কেন । এর উত্তর এই পৃথিবী সূর্যের টান মেনেও দৌড়ের বেগে তফাত থাকতে পারে। দৌড় যদি যথেষ্ট পরিমাণ বেশি হত তা হলে টানের বঁাধন ছিড়ে শূন্যে বেরিয়ে পড়ত, দৌড়ের বেগ যদি ক্লান্ত হত তা হলে সূর্য তাকে নিত আত্মসাৎ করে । অণুদের মধ্যে ফাকি থেকে যায়। গতির বেগে, তাতেই বাধনের শক্তিকে ঠেলে রেখে দেয় । গ্যাসীয় পদার্থের গতির প্রাধান্য বেশি। অণুর দল এই অবস্থায় এত দ্রুত বেগে চলে যে তাদের পরম্পরের মিল ঘটবার অবকাশ থাকে না । মাঝে মাঝে তাদের সংঘাত হয়। কিন্তু মুহুর্তেই আবার যায় সরে। তরল পদার্থে আণবিক আকর্ষণের শক্তি সামান্য বলেই চলন-বেগের জন্যে তাদের মধ্যে অতিঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয় না। নিরেট বস্তুতে বাধনের শক্তিটা অপেক্ষাকৃত প্রবল। তাতে অণুর দল সীমাবদ্ধ স্থানের ভিতর আটকা পড়ে থাকে। তাই বলে তারা যে শান্ত থাকে তা নয়। তাদের মধ্যে কম্পন চলছেই। কিন্তু তাদের স্বাধীনতার ক্ষেত্র অল্পপরিসর ।