পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাভাষা-পরিচয় ' 6አክrs2 ክr বাংলাভাষা ভারতবর্ষের প্রায় পাঁচ কোটি লোকের ভাষা। হিন্দি বা হিন্দুস্থানি যাদের যথার্থ ঘরের ভাষা, শিক্ষা-করা ভাষা নয়, সুনীতিকুমার দেখিয়েছেন, তাদের সংখ্যা চার কোটি বারো লক্ষের কাছাকাছি। এর উপরে আছে আট কোটি আটাশি লক্ষ লোক যারা তাদের খাটি মাতৃভাষা বর্জন করে সাহিত্যে সভাসমিতিতে ইস্কুলে আদালতে হিন্দুস্থানির শরণাপন্ন হয়। তাই হিন্দুস্থানিকে ভারতের রাষ্ট্ৰীয় ব্যবহারের জন্যে এক ভাষা বলে গণ্য করা যেতে পারে । তার মানে, বিশেষ কাজের প্রয়োজনে কোনো বিশেষ ভাষাকে কৃত্রিম উপায়ে স্বীকার করা চলে, যেমন আমরা ইংরেজি ভাষাকে স্বীকার করেছি। কিন্তু ভাষার একটা অকৃত্রিম প্রয়োজন আছে ; সে প্রয়োজন কোনো কাজ চালাবার জন্যে ଗର୍ଖ, ଐଶ୍ୱାCoଖ ଔ(୩) । রাষ্ট্রিক কাজের সুবিধা করা চাই বৈকি, কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কাজ দেশের চিত্তকে সরস সফল ও সমুজ্জ্বল করা। সে কােজ আপনি ভাষা। নইলে হয় না। দেউড়িতে একটা সরকারি প্রদীপ জ্বালানো চলে, কিন্তু একমাত্র তারই তেল জোগাবার খাতিরে ঘরে ঘরে প্রদীপ নেবানো চলে না । এই প্রসঙ্গে যুরোপের দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক । সেখানে “দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা অথচ এক সংস্কৃতির ঐক্য সমস্ত মহাদেশে । সেখানে বৈষয়িক অনৈক্যে যারা হানাহানি করে এক সংস্কৃতির ঐক্যে তারা মনের সম্পদ নিয়তই অদল বদল করছে। ভিন্ন ভিন্ন ভাষার ধারায় বয়ে নিয়ে আসা পণ্যে সমৃদ্ধিশালী য়ুরোপীয় চিত্ত জয়ী হয়েছে সমস্ত পৃথিবীতে । তেমনি ভারতবর্ষেও ভিন্ন ভিন্ন ভাষার উৎকর্ষ-সাধনে দ্বিধা করলে চলবে না। মধ্যযুগে য়ুরোপে সংস্কৃতির এক ভাষা ছিল লাটিন । সেই ঐক্যের বেড়া ভেদ করেই যুরোপের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা যেদিন আপন আপন শক্তি নিয়ে প্রকাশ পেলে সেই দিন য়ুরোপের বড়ো দিন । আমাদের দেশেও সেই বড়েদিনের অপেক্ষা করবে- সব ভাষা একাকার করার দ্বারা নয়, সব ভাষার আপনি আপনি বিশেষ পরিণতির দ্বারা । বাংলাভাষাকে চিনতে হবে ভালো করে ; কোথায় তার শক্তি, কোথায় তার দুর্বলতা, দুইই আমাদের জান চাই । রূপকথায় বলে, এক-যে ছিল রাজা, তার দুই ছিল রানী, সুয়োরানী আর দুয়োরানী । তেমনি বাংলাবােক্যাধীপেরও আছে দুই রানী— একটাকে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছে সাধু ভাষা ; আর-একটাকে কথ্য ভাষা, কেউ বলে চলতি ভাষা, আমার কোনো কোনো লেখায় আমি বলেছি প্রাকৃত বাংলা । সাধু ভাষা মাজাঘাষা, সংস্কৃত ব্যাকরণ অভিধান থেকে ধার করা অলংকারে সাজিয়ে তোলা । চলতি ভাষার আটপৌরে সাজ নিজের চরকায় কাটা সূতো দিয়ে বোনা । অলংকারের কথা যদি জিজ্ঞাসা কর কালিদাসের একটা লাইন তুলে দিলে তার জবাব হবে ; কবি বলেন ; কিমিব হি মধুরাণাং মণ্ডনং নাকৃতীনাম। যার মাধুর্য আছে সে যা পরে তাতেই তার শোভা । রূপকথায় শুনেছি সুয়োরানী ঠাই দেয় দুয়োরানীকে গোয়ালঘরে। কিন্তু গল্পের পরিণামের দিকে দেখি সুয়োরানী যায় নির্বাসনে, টিকে থাকে একলা দুয়োরানী রানীর পদে। বাংলায় চলতি ভাষা বহু কাল ধরে জায়গা পেয়েছে সাধারণ মাটির ঘরে, হেঁশেলের সঙ্গে, গোয়ালের ধারে, গোবর-নিকোনো আঙিনার পাশে যেখানে সন্ধেবেলায় প্ৰদীপ জ্বালানো হয় তুলসীতলায় আর বোটমী এসে নাম শুনিয়ে যায় ভোরবেলাতে। গল্পের শেষ অংশটা এখনো সম্পূর্ণ আসে নি, কিন্তু আমার বিশ্বাস সুয়োরানী নেবেন বিদায়। আর একলা দুয়োরানী বসবেন রাজাসনে । চলতি ভাষার চলার বিরাম নেই, তার চলাবার শক্তি আড়ষ্ট হবার সময় পায় না।