পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ሎክrbr রবীন্দ্র-রচনাবলী হয় । চাকা সেই জড়িত্বের মধ্যে প্ৰাণ এনে দিলে । আদানপ্রদানের কাজ চলল বেগে । ভাষার দেশে সেই চাকা এসেছে ছন্দের রূপে। সহজ হল মোট বাধা কথাগুলিকে চালিয়ে দেওয়া । মুখে মুখে চলল ভাষার দেনা-পাওনা । কবিতার বিশেষত্ব হচ্ছে তার গতিশীলতা । সে শেষ হয়েও শেষ হয় না। গদ্যে যখন বলি একদিন শ্রাবণের রাত্রে বৃষ্টি পড়েছিল, তখন এই বলার মধ্যে এই খবরটা ফুরিয়ে যায়। কিন্তু কবি যখন <er রজনী শাঙনঘন ঘন দেয়াগারজন রিমঝিম শবদে বরিযে তখন কথা থেমে গেলেও বলা থামে না । এ বৃষ্টি যেন নিত্যকালের বৃষ্টি, পঞ্জিকা-আশ্ৰিত কোনো দিনক্ষণের মধ্যে বদ্ধ হয়ে এ বৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে যায় নি। এই খবরটির উপর ছন্দ যে দোলা সৃষ্টি করে দেয় সে দোলা ঐ খবরটিকে প্রবহমান করে ቘቨርሃ ! অণু পরমাণু থেকে আরম্ভ করে নক্ষত্ৰলোক পর্যন্ত সর্বত্রই নিরন্তর গতিবেগের মধ্যে ছন্দ রয়েছে। বস্তুত এই ছন্দই রূপ। উপাদানকে ছন্দের মধ্যে তরঙ্গিত করলেই সৃষ্টি রূপ ধারণ করে । ছন্দের বৈচিত্ৰ্যই রূপের বৈচিত্ৰ্য। বাতাস যখন ছন্দে কঁপে তখনই সে সুর হয়ে ওঠে । ভাবকে কথাকে ছন্দের মধ্যে জাগিয়ে তুললেই তা কবিতা হয়। সেই ছন্দ থেকে ছাড়িয়ে নিলেই সে হয় সংবাদ ; সেই সংবাদে প্ৰাণ নেই, নিত্যতা নেই। মেঘদূতের কথা ভেবে দেখো । মনিব একজন চাকরকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে, গদ্যে এই খবরের মতো এমন খবর তো সর্বদা শুনছি। কেবল তফাত এই যে, রামগিরি অলকার বদলে হয়তো আমরা আধুনিক রামপুরহাট হাটখোলার নাম পাচ্ছি। কিন্তু মেঘদূত কেন লোকে বছর বছর ধরে পড়ছে। কারণ, মেঘদূতের মন্দাক্রান্তা ছন্দের মধ্যে বিশ্বের গতি নৃত্য করছে। তাই এই কাব্য চিরকালের সজীব বস্তু। গতিচাঞ্চল্যের ভিতরকার কথা হচ্ছে, “আমি আছি। এই সত্যটির বিচিত্র অনুভূতি। “আমি আছি। এই অনুভূতিটা তো বদ্ধ নয়, এ-যে সহস্র রূপে চলায় ফেরায় আপনাকে জানা । যতদিন পর্যন্ত আমার সত্তা স্পন্দিত নন্দিত হচ্ছে ততদিন “আমি আছিরি বেগের সঙ্গে সৃষ্টির সকল বস্তু বলছে, “তুমি যেমন আছ আমিও তেমনি আছি।’ ‘আমি আছি। এই সত্যটি কেবলই প্রকাশিত হচ্ছে “আমি চলছিাঁর দ্বারা। চলটি যখন বাধাহীন হয়, চার দিকের সঙ্গে যখন সুসংগত হয়, সুন্দর হয়, তখনই আনন্দ ; ছন্দোময় চলমানতার মধ্যেই সত্যের আনন্দরাপ। আর্টে কাব্যে গানে প্রকাশের সেই আনন্দমূর্তি ছন্দের দ্বারা ব্যক্ত হয়। একদা ছিল না ছাপাখানা, অক্ষরের ব্যবহার হয় ছিল না নয় ছিল অল্প। অথচ মানুষ যে-সব কথা সকলকে জানাবার যোগ্য মনে করেছে। দলের প্রতি শ্ৰদ্ধায়, তাকে বেঁধে রাখতে চেয়েছে এবং চালিয়ে দিতে চেয়েছে পরম্পরের কাছে। এক শ্রেণীর কথা ছিল যেগুলো সামাজিক উপদেশ । আর ছিল চাষাবাসের পরামর্শ, শুভ-অশুভের লক্ষণ, লগ্নের ভালোমন্দ ফল । এই সমস্ত পরীক্ষিত এবং কল্পিত কথাগুলোকে সংক্ষেপ করে বলতে হয়েছে, ছন্দে বঁধতে হয়েছে, স্থায়িত্ব দেবার জন্যে। দেবতার স্তুতি, পৌরাণিক আখ্যান বহন করেছে। ছন্দ । ছন্দ তাদের রক্ষা করেছে যেন পেটিকার মধ্যে। সাহিত্যের প্রথম পর্বে ছন্দ মানুষের শুধু খেয়ালের নয়, প্রয়োজনের একটা বড়ো সৃষ্টি ; আধুনিক কালে যেমন সৃষ্টি তার ছাপাখানা। ছন্দ তার সংস্কৃতির ধাত্রী ছন্দ তার স্মৃতির ভাণ্ডারী। চলতি ভাষার স্বভাব রক্ষা করে বাংলা ছন্দে কবিতা যা লেখা হয়েছে সে আমাদের লোকগাথায়, বাউলের গানে, ছেলে ভোলাবার ও ঘুম পাড়াবার ছড়ায়, ব্ৰতকথায়। সাধুভাষী সাহিত্যমহলের বাইরে তাদের বসতি। তারা যে সমন্তই প্রাচীন তা নয়। লক্ষণ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, তাদের অনেক আছে যারা আমাদের সমান বয়সেরই আধুনিক, এমনকি ছন্দে মিলে ভাবে আমাদেরই শাকরেদি সন্দেহ