পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

tS রবীন্দ্র-রচনাবলী ও পারেতে দুটি মেয়ে নাইতে নেবেছে, ঝুনুকুনুচুলগাছটি ঝাড়তে নেগেছে। কে দেখেছে, কে দেখেছে, দাদা দেখেছে। আজ দাদার ঢেলা ফেলা, কাল দাদার বে। দাদা যাবে কোনখান দে, বকুলতলা দে । বকুল ফুল কুড়োতে কুড়োতে পেয়ে গেলুম মালা । রামধনুকে বান্দি বাজে সীতেনাথের খেলা । সীতেনাথ বলে রে ভাই, চালকড়াই খাব ৷ চালকড়াই খেতে খেতে গলা হল কাঠ । হেথা হােথা জল পাব। চিৎপুরের মাঠ । চিৎপুরের মাঠেতে বালি চিকচিক করে, চাদমুখে রোদ নোগে রক্ত ফেটে পড়ে । সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা একটা অর্থের অতীত রস পেয়েছে ; ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মােহ এনেছে তাদের মনের মধ্যে । সেইজনে অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর আয়ু বেড়ে চলেছে। এর ছন্দের চাকী ঘুরে চলেছে বহু শতাব্দীর রাস্তা পেরিয়ে । আদিম কালের মানুষ তার ভাষাকে ছন্দের দোল লাগিয়ে নিরর্থক নাচাতে কুষ্ঠিত হয় নি। নাচের নেশা আছে তার রক্তে । বুদ্ধি যখন তার চেতনায় একাধিপত্য করতে আরম্ভ করেছে, তখনই সে নেশা কাটিয়ে উঠে মেনেছে শব্দের সঙ্গে অর্থের একান্ত যোগ । আদিম মানুষ মন্ত্র বানিয়েছে, সে মস্ত্রের শব্দে অর্থের শাসন নেই অথবা আছে সামান্য । তার মন ছন্দে দোলায়িত ধ্বনির রহস্যে ছিল অভিভূত ; তার মনে ধ্বনির এই-যে সম্মোহনপ্রভাব, দেবতার উপরে, প্রাকৃতিক শক্তির উপরেও তার ক্রিয়া সে কল্পনা করত। তাই সঁওতাল প্রভৃতি আদিম জাতির অনেক গানের শব্দে অর্থ হয়েছে গীেণ ; অর্থের যে আভাস আছে সে কেবল ধ্বনির গুণে মনের মধ্যে মোহ বিস্তার করে, অর্থাৎ কোনো স্পষ্ট বার্তার জন্যে তার আদর নয়, ব্যঞ্জনার অনিৰ্দেশ্যতাই তাকে প্রবলতা দেয় । মা তার ছেলেকে নাচাচ্ছে (९न्म क्राbन्म 6९न्मl, বট পাকুড়ের ফেনা । বলদে খালো চিনা, ছাগলে খালো ধান, সোনার জাদুর জন্যে যায়ে নাচনা কিনে আন। এর মধ্যে খানিকটা অর্থহীন ধ্বনি, খানিকটা অর্থবান ছবির টুকরো নিয়ে যে ছড়া বানানো হয়েছে তাতে আছে সেই নাচন যে নাচন স্বপ্নলোকে কিনতে পাওয়া যায়। এই-যে ধ্বনিতে অর্থে মিলে মনের মধ্যে মোহাবেশ জাগিয়ে তোলা, এটা সকল যুগের কবিতার মধ্য দিয়েই কমবেশি প্রকাশ পায় ; তাই অর্থের প্রবলতা বেড়ে উঠলে কবিতার সম্মোহন যায় কমে ! ধ্বনির ইশারা দিয়ে যা নিজেকে অভাবনীয় রূপে সার্থক করে তোলে, শিক্ষকের ব্যাখ্যার দ্বারা তা যখন সমর্থনের অপেক্ষা করে তখন কবিতার মন্ত্রশক্তি হারায় তার গুণ । ছন্দ আছে জাদুর কাজে, খেয়াল গেলে বুদ্ধিকে অগ্রাহ্য করতে সে সাহস করে । সাহিত্যের মধ্যে কারুকাজ, কাব্যে যার প্রাধান্য, তার একটা দিক হচ্ছে শব্দের বাছাই-সজাই করা : কালে কালে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ভাষায় শব্দ জমে যায় বিস্তুর । তার মধ্যে থেকে বেছে নিতে হয় এমন শব্দ যা কল্পনার ঠিক ফরমাশটি মানতে পারে পুরো পরিমাণে । রামপ্রসাদ বলেছেন ; আমি করি দুখের বড়াই। “বড়াই-বর্গের অনেক ভায়ী ভারী কথা ছিল : গর্ব করি, গৌরব করি, মাহাত্ম্য বোধ করি। কিন্তু “দুঃখকেই বড়ো করে নিয়েছি বলবার জন্যে অমন নিতান্ত সহজ অর্থাৎ ঠিক কথাটি বাংলাভাষায় আর নেই।