পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাভাষা-পরিচয় VO? অসংগত ব্যবহার বিদেশীদের পক্ষে বিষম সংকটের। বাংলা এ সম্বন্ধে বান্তবকে মানে। বাংলায় কোনোদিন ঘুড়ি উড়ীয়মানা হবে না, কিংবা বিজ্ঞাপনে নিৰ্মলা চিনির পাকে সুমুধুরা রসগোল্লার শ্ৰেষ্ঠত্ব ঘোষণা করবে না। কিংবা শুশ্ৰষ্যার কাজে দারুশ মাথাধরায় বরফশীতল জলপটির প্রয়োগ-সম্ভাবনা ( এইখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি। সংস্কৃত ভাষার নিয়মে বাংলার নীলিঙ্গ প্রত্যয়ে এবং অন্যত্র দীর্ঘ ঈ-কার বা ন'এ দীর্ঘ ঈ-কার মানবার যোগ্য নয়। ধাটি বাংলাকে বাংলা বলেই স্বীকার করতে যেন লজ্জা না করি, প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা যেমন আপনি সত্য পরিচয় দিতে লজ্জা করেনি। অভ্যাসের দোষে সম্পূর্ণ পারব না, কিন্তু লিঙ্গভেদসূচক প্রত্যয়ে সংস্কৃত ব্যাকরণ কতকটা স্বীকার করার দ্বারা তার ব্যভিচারটাকেই পদে পদে ঘোষণা করা হয়। তার চেয়ে ব্যাকরণের এই সকল স্বেচ্ছাচার বাংলা ভাষারই প্রকৃতিগত এই কথাটা স্বীকার করে নিয়ে যেখানে পারি। সেখানে খাটি বাংলা উচ্চারণের একমাত্র হ্রস্ব ঈকারকে মানব। ইংরেজি বা “মুসলমনি’ শব্দে যে ই-প্রত্যয় আছে সেটা যে সংস্কৃত নয়, তা জানাবার জন্যই অসংকোচ হ্রস্ব-ইকার ব্যবহার করা উচিত। ওটাকে ইন-ভাগান্ত গণ্য করলে কোন দিন কোনো পণ্ডিতভিমানী লেখক মুসলমানিনী কায়দা বা ‘ইংরেজিনী রাষ্ট্রনীতি বলতে গীেরব বোধ SGR AN TOTS (RIRs Rt | S8 বাংলা বিশেষ্যপদে বহুবচনের প্রভাব অল্পই। অধিকাংশ স্থলেই সব গুলি "সকল প্রভৃতি শব্দ জোড়া দিয়ে কাজ চালানো হয়। এ ভাষায় সর্বনাম শব্দে বহুবচনের বিভক্তি যতটা চলে অন্যত্র ততটা নয় । বহুবচনে “মানুষরা" বলে থাকি অথচ ‘ঘোড়ারা বলতে কানে ঠেকে, অথচ ‘ঘোড়াদের বলা চলে । মোটের উপর এ কথা খাটে যে সচেতন জীবদের নিয়ে বহুবচনে রা এবং সম্বন্ধে ও কর্মকারকে দের চিহ্ন ব্যবহার হয়ে থাকে । ‘মোষেরা খুব বলবান জীব বা ‘ময়ূরদের পুচ্ছ লম্বা' এটা নিয়মবিরুদ্ধ নয় । এই রা চিহ্ন সাধারণ বিশেষ্যে লাগে । বিশেষ বিশেষ্যে। ওর প্রয়োগ কানে বাধে । বলতে পারি। “ঐ মোষরা পাকে ডুবে আছে, কিন্তু “ঐ মোষগুলো পাকে ডুবে আছে বললেই মানানসই হয় । ‘মোষরা বললে মোষজাতিকে মনে আসে, ‘মোষগুলো’ বললে মনে আসে বিশেষ মোষের দল । “মানুষরা নিষ্ঠুরতায় পশুকে হার মানালো ঠিক শোনায়, এও ঠিক শোনায় : কুলিগুলো নির্দয়ভাবে গাড়িতে বোঝা চাপিয়েছে। কিন্তু “মানুষগুলো পশুকে হার মানায় অশুদ্ধ । সাধারণ বিশেষ্যেরা চলে, কিন্তু বিশেষ বিশেষ্যে গুলো । ‘মানুষরা ওখানে জটলা করছে বললে মনে হয় যেন জানানো হচ্ছে অন্য কোনো জীব করে নি। এখানে মানুষগুলো' বললেই সংশয় থাকে না । ‘টেবিলরা’, ‘চৌকিরা' নিষিদ্ধ। জড়পদার্থের “গুলো ছাড়া গতি নেই। আর-একটা শব্দ আছে, কথার পর্বে বসে সমষ্টি বোঝায়, যেমন সব’ : সব চৌকি, সব জন্তু, সব মানুষ । কিন্তু এখানে এই শব্দ কেবলমাত্র বহুবচন বোঝায় না, সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝোক দেয় । সব চৌকি সরিয়ে দাও, অর্থাৎ একটাও বাকি রেখো না । সব ভিখিরিই বাঙালি, অর্থাৎ নির্বিশেষে বাঙালি । “সব প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ‘গুলো প্রয়ােগটি যোগ দিতে চায়, যেমন : সব চৌকিগুলোই ভাঙা, সব ভিখিরিগুলোই চেঁচাচ্ছে। এখানে সব’ বোঝাচ্ছে একান্ততা, আর ‘গুলো' বোঝাচ্ছে বহুবচন । বহুবচনে এক সময়ে সব ব্যবহৃত হত । কবিতায় এখনো দেখা যায়, যেমন : পাখিসব তোমাসব ইত্যাদি । আমরা বলি : কাফ্রিরা সব কালো । বহুবচনের রা বিভক্তির সঙ্গে জোড়া লাগে ‘সব' শব্দ ; এরা সব গেল কোথায় । শুধু ‘এরা গোল কোথায় বললেই চলে, কিন্তু সব শব্দের দ্বারা সমষ্টির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে । এই সব শব্দ একবচনকে বহুবচন করে না, বহুবচনকে সুনির্দিষ্ট করে। সবাই শব্দে আরো বেশি জোর লাগে : এরা যে সবাই চলে গেছে, কিম্বা, চৌধুরীদের সবাইকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সব শব্দের সমার্থক হচ্ছে