পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ՆՀեr রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের দেশে এত নীরন্ধ নিবিড় যে, পরের মতো পর আমাদের কাছে আর কিছুই নাই। এইজনাই অল্প সময়ের জন্যও বাহির হইতে হইলেও সকলের কাছে আমাদের এত বেশি জবাবদিহি কবি হয়। বাঁধা থাকিয়া থাকিয়া আমাদের ডানা এমনি বন্ধ হইয়া গিয়াছে যে, উড়িবার আনন্দ যে একটি আনন্দ, এ কথাটা আমাদের দেশে বিশ্বাসযোগ্য নহে। অল্প বয়সে যখন বিদেশে গিয়াছিলাম তখন তাহার মধ্যে একটা আর্থিক উদ্দেশ্য ছিল, সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের বা বারিস্টার হওয়ার চেষ্টা একটা ভালো কৈফিয়ত- কিন্তু, বাহান্ন বৎসর বয়সে সে কৈফিয়ত খাটে না, এখন কোনো পারমার্থিক উদ্দেশ্যের দোহাই দিতে হইবে । আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য ভ্রমণের প্রয়োজন আছে, এ কথাটা আমাদের দেশের লোকেরা মানিয়া থাকে । সেইজন্য কেহ কেহ কল্পনা করিতেছেন, এ বয়সে আমার যাত্রার উদ্দেশ্য তাঁহাই। এইজনা তাহারা আশ্চর্য হইতেছেন, সে উদ্দেশ্য যুরোপে সাধিত হইবে কী করিয়া। এই ভারতবর্ষের তীর্থে ঘুরিয়া এখানকার সাধু সাধকদের সঙ্গ লাভ করাই একমাত্র মুক্তির উপায়। আমি গোড়াতেই বলিয়া রাখিতেছি। কেবলমাত্র বাহির হইয়া পড়াই আমার উদ্দেশ্য। ভাগ্যক্রমে পৃথিবীতে আসিয়াছি, পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় যথাসম্ভব সম্পূর্ণ করিয়া যাইব, ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। দুইটা চক্ষু পাইয়াছি, সেই দুটা চক্ষু বিরাটকে যত দিক দিয়া যত বিচিত্র করিয়া দেখিবে ততই সাৰ্থক হইবে । তবু এ কথাও আমাকে স্বীকার করিতে হইবে যে, লাভের প্রতিও আমার লোভ আছে ; কেবল সুখ নহে, এই ভ্রমণের সংকল্পের মধ্যে প্রয়োজনসাধনেরও একটা ইচ্ছা গভীরভাবে লুকানো রহিয়াছে। আমি মনে করি, য়ুরোপের কেহ যদি যথার্থ শ্রদ্ধা লইয়া ভারতবর্ষ ভ্ৰমণ করিয়া যাইতে পারেন তবে র্তাহারা তীর্থভ্রমণের ফললাভ করেন। তেমন য়ুরোপীয়ের সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছে, আমি তাহাদিগকে ভক্তি করি । B DDDBD DBDBB D BDBB BS DBD0B DDBB DBD DDBD KY D প্রতিফলিত হইয়া আমাদের কাছে উজ্জ্বল হইয়া দেখা দেয় । তাহদেরই হৃদয়ের শক্তি দেখিয়া আমার মন প্ৰণত হয়। অপরিচয়ের বাধা ভেদ করিয়া সত্যকে স্বীকার ও কল্যাণকে গ্ৰহণ করিবার ক্ষমতা সর্বদা দেখিতে পাই না। পরের দেশে না গেলে সত্যের মধ্যে সহজে সঞ্চারণ করিবার শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না। যাহা অভ্যন্ত তাহাকেই বড়ো সত্য বলিয়া মানা ও যাহা অনভ্যন্ত তাহাকেই তুচ্ছ বা মিথ্যা বলিয়া বর্জন করা, ইহাই দীনাত্মার লক্ষণ। অনভ্যাসের মন্দিরের কপাট ঠেলিয়া যখন আমরা সত্যকে পূজা দিয়া আসিতে পারি, তখন সত্যের প্রতি ভক্তিকে আমরা বিশেষভাবে উপলব্ধি করিতে পারি। আমাদের সেই পূজা স্বাধীন ; আমাদের সেই ভক্তি প্রথার দ্বারা অন্ধভাবে চালিত নহে। যুরোপে গিয়া সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিতে আমরা সত্যকে প্রত্যক্ষ করিব, এই শ্রদ্ধাটি লইয়া যদি আমরা সেখানে যাত্রা করি তবে ভারতবাসীর পক্ষে এমন তীর্থ পৃথিবীতে কোথায় মিলিবে । ভারতবর্ষে আমি শ্রদ্ধাপরায়ণ যে যুরোপীয় তীর্থযাত্ৰাদিগকে দেখিয়াছি আমাদের দুৰ্গতি যে তঁহদের চোখে পড়ে নাই তাহা নহে, কিন্তু সেই ধুলায় তাহাদিগকে অন্ধ করিতে পারে নাই; জীৰ্ণ আবরণের আড়ালেও ভারতবর্ষের অন্তরতম সত্যকে তাহারা দেখিয়াছেন । যুরোপেও যে সত্যের কোনো আবরণ নাই তাঁহা নহে। সে আবরণ জীৰ্ণ নহে, তাহা সমুজ্জ্বল । এইজন্যই সেখানকার অন্তরতম সত্যটিকে দেখিতে পাওয়া হয়তো আরো কঠিন। বীর প্রহরীদের দ্বারা রক্ষিত, মণিমুক্তার ঝালারের দ্বারা খচিত, সেই পদটিকেই সেখানকার সকলের চেয়ে মূল্যবান পদার্থ মনে করিয়া আমরা আশ্চর্য হইয়া ফিরিয়া আসিতে পারি।-- তাহার পিছনে যে দেবতা বসিয়া আছেন তঁহাকে হয়তো প্ৰণাম করিয়া আসা ঘটিয়া উঠে না । সেই পদটিাই আছে আর তিনি নাই, এমন একটা অদ্ভূত অশ্রদ্ধা লইয়া যদি সেখানে যাই। তবে এই পথ-খরচাটার মতো এতবড়ো অপব্যয় আর কিছুই হইতে পারে না।