পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ve রবীন্দ্র-রচনাবলী দুৰ্গতির প্রতিকার হইবে, রাষ্ট্রশাসনসভায় আসন লাভ করিলে আমরা মানুষ হইয়া উঠিব- কিন্তু জাতীয় সদগতি কলের সামগ্ৰী নহে, এবং মানুষের আত্মা যতক্ষণ আপনার ভিতর হইতে তাহর পুব মূল্য চুকাইয়া দিবার জন্য প্রস্তুত হইতে না পরিবে ততক্ষণ, নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে আয়নায়। তাই বলিতেছিলাম, তীর্থযাত্রার মানস করিয়াই যদি যুরোপে যাইতে হয় তবে তাহ নিম্ফল হইবে না । সেখানেও আমাদের গুরু আছেন ; সে শুরু সেখানকার মানবসমাজের অন্তরতম দিবাশক্তি । সর্বত্রই গুরুকে শ্ৰদ্ধার গুণে সন্ধান করিয়া লইতে হয় ; চোখ মেলিলেই তাহাকে দেখা যায় না। সেখানেও সমাজের যিনি প্রাণপুরুষ, অন্ধতা ও অহংকার-বগত ঠাঁহাকে না দেখিয়া ফিরিয়া আসা অসম্ভব নহে ; এবং এমন একটা অদ্ভুত ধারণা লইয়া আসাও আশ্চর্য নহে যে- ইংলন্ডের প্রতাপ পার্লামেন্টের দ্বারা সৃষ্ট হইতেছে- য়ুরোপের ঐশ্বৰ্য কারখানাঘরে প্রস্তুত হইতেছে এবং পাশ্চাত্য মহাদেশের সমস্ত মাহাত্ম্য যুদ্ধের অন্ত্র, বাণিজ্যের জাহাজ এবং বাহবন্তপুঞ্জের দ্বারা সংঘটিত । নিজের মধ্যে শক্তির সত্য অনুভূতি যাহার নাই অতি সহজেই সেই মনে করিয়া বসে, শক্তি বাহিরেই আছে এবং যদি কোনো সুযোগে আমরাও কেবলমাত্র ঐ জিনিসগুলা দখল করিতে পারি তাহা হইলেই আমাদের অভাবপূরণ হয়। কিন্তু, যেনাহং নামৃত স্যাম কিমহং তেন। কুৰ্যাম- এ কথাটি য়ুরোপেরও অন্তরের কথা। যুরোপও নিশ্চয়ই জানে, রেলে টেলিগ্রাফে কলে কারখানায় সে বড়ো নহে। এইজন্যই যুরোপ বীরের ন্যায় সত্যব্ৰত গ্ৰহণ করিয়াছে ; বীরের ন্যায় সত্যের জন্য ধনপ্রাণ উৎসর্গ করিতেছে ; এবং যতই ভুল করিতেছে, যতই ব্যর্থ হইতেছে, ততই দ্বিগুণতর উৎসাহের সহিত নূতন করিয়া উদ্যোগ আরম্ভ করিতেছে- কিছুতেই হাল ছাড়িয়া দিতেছে না। মাঝে মাঝে অমঙ্গল দেখা দিতেছে, সংঘাতে সংঘর্ষেবহ্নিজ্বলিয়া উঠিতেছে, সমুদ্রমন্থনে মাঝে মাঝে বিষও উদগীর্ণ হইতেছে, কিন্তু মন্দকে তাহারা কোনোমতেই মানিয়া লইতেছে না। অন্ত্র তাহাদের প্রস্তুত, সৈন্যদল তাহদের নির্ভীক, এবং সত্যের দীক্ষায় তাহারা মৃত্যুজয়ী বল লাভ করিয়াছে। সত্যের সম্মুখীন হইতে আমরা আলস্য করিয়াছি, সত্যের সাধনায় আমরা উদাসীন, আমরা ঘরগড়া বাধা-বাধনের মধ্যে আপাদমস্তক আপনাকে জড়াইয়া তাহাকেই সত্য আশ্রয় বলিয়া কল্পনা করিয়াছি। সেইজন্য বিপদের দিন যখন আসন্ন হয়, সত্য পন্থী ব্যতীত যখন আমাদের আর গতি নাই, তখন আমরা কিছুতেই আপনাকে জাগ্রত করিতে পারি না, আপনাকে ত্যাগ করিতে পারি না। তখনো খেলা করাকেই কাজ করা মনে করি, নকল করিয়াই আসলের ফল প্রত্যাশা করি, কৃত্রিম উৎসাহকে উদ্দীপ্ত রাখিতে পারি না, আরন্ধ কর্মকে শেষ করিতে পারি না এবং ভূরিপরিমাণ তাত্ত্বিকতা ও ভাবুকতার জালে জড়িত হইয়া বারংবার ব্যর্থ হইতে থাকি । সেইজন্য সত্যের দায়িত্বকে বীরের ন্যায় সর্বািন্তঃকরণে স্বীকার করিবার দীক্ষা, সেই সত্যের প্রতি অবিচলিত প্ৰাণান্তিক নিষ্ঠা, জীবনের সমস্ত শ্ৰেষ্ঠ সম্পদকে প্রাণপণ দুঃখের মূল্য দিয়া অর্জন করিবার সাধনা, এবং বুদ্ধি হৃদয় ও কর্মে সকল দিক দিয়া মানুষের কল্যাণসাধন ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা দ্বারা ভগবানের দুঃসাধ্য সেবাব্রত গ্ৰহণ করিবার জন্য তীর্থযাত্রীর পক্ষে য়ুরোপে যাত্রা কখনোই নিম্ফল হইতে পারে না। অবশ্য, যদি তাহার মনে শ্রদ্ধা থাকে এবং সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণতাকেই যদি সে আধ্যাত্মিক সাফল্যের সত্য পরিচয় বলিয়া বিশ্বাস করে । আমি জানি, য়ুরোপের সঙ্গে এক জায়গায় আমাদের স্বার্থের সংঘাত ঘটিয়াছে এবং সেই সংঘাতে আমাদিগকে অন্তরে বাহিরে অনেক স্থলে গভীর বেদন পাইতে হইতেছে। সে বেদনা আমাদের আধ্যাত্মিক দৈন্যেরই দুঃখ এবং আমাদের সঞ্চিত পাপেরই প্ৰায়শ্চিত্ত হইলেও তাঁহা বেদনা। আমাদের পক্ষে এই বেদনার উপলক্ষ যাহারা তাহদের ক্ষুদ্রতা ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় আমরা নানা আকারে পাইয়া থাকি । ইহাও আমরা প্ৰতিদিন দেখিয়াছি, তাহারা নিজের নীচতাকে উদ্ধত কপটতার দ্বারা গোপন করিয়াছে ও পরািজাতীয়ের মাহাত্ম্যকে অন্ধতা ও অহংকারের দ্বারা অস্বীকার করিয়াছে। এই কারণেই আমাদের সেই ক্ষতিবেদনা লইয়া যুরোপের সত্যকে দেখিতে ও তাহাকে গ্ৰহণ করিতে আমরা অন্তরের মধ্যে বাধা পাইয়া থাকি । তাহদের ধর্মকেও আমরা অবিশ্বাস করি ও তাহদের সভ্যতাকে আমরা বস্তুজােলজড়িত স্থলপদাৰ্থ বলিয়া নিন্দা কবিয়া থাকি। শুধু তাহাঁই নহে, আমাদের ভয় আছে, পাছে