পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

yQA প্রবলের প্রবলতাকেই আমরা সত্যের আসন দিয়া তাহার পূজা করি ও তাহার কাছে ধূলিলুষ্ঠিত হইয়া আপনাকে অপবিত্র করি ; পাছে অন্যের গীেরবকে নিজের গীেরবের সহিত গ্ৰহণ করিতে না পারি ; পাছে আত্ম-অবিশ্বাসের অবসাদে নিজের সত্যকে বিসর্জন দিয়া অনুকরণের শূন্যতার মধ্যে পরের কায়ার ছায়া ও পরের ধ্বনির প্রতিধ্বনি হইয়া জগৎ-সংসারে নিজেকে একেবারে ব্যর্থ করিয়া দিই। ; পাছে এইরূপ একটা অদ্ভুত ভ্ৰম করিয়া বসি যে, অন্যকে স্বীকার করিতে গিয়া নিজেকে অস্বীকার করিয়া বাসাঁই যথার্থ ঔদার্যের পন্থা । এই সমস্ত বিয়বিপদ আছে ; সেইজন্যই এই পথে সত্যসন্ধানের যাত্ৰা তীর্থযাত্রা । সমান্ত অসত্যকে উত্তীর্ণ হইয়াই চলিতে হইবে ; বাধার দুঃখকে সহ্য করিয়াই অগ্রসর হইতে হইবে ; আত্ম-অতিমানের ব্যৰ্থ বোঝাকে পশ্চাতে ফেলিয়া যাইতে হইবে, অথচ আত্মগীেরবের পাথেয়াকে একান্ত যত্নে রক্ষা করিয়া চলিতে হইবে । বস্তুত, অত্যন্ত বিয়ের দ্বারাই আমরা এই তীর্থযাত্রার পূর্ণ ফললাভের আশা করিতে পারি ; কারণ যাহা সহজে পাই তাহা সচেতন হইয়া গ্ৰহণ করি না, অথচ কোনো মহৎ লাভের যথার্থ সফলতাই চেতনার পূর্ণতর বিকাশ, অর্থাৎ, আমরা যাহা-কিছু সত্যভাবে লাভ করি তাহার দ্বারা আপনাকেই সত্যতাররূপে উপলব্ধি করি।- তাহা যদি না করি, যদি বাহিরের বস্তুকেই বাহিরে পাই, उाव उांश भाशा, उांश शिक्षा । বোম্বাই শহর বোম্বাই শহরটার উপর একবার চোখ বুলাইয়া আসিবার জন্য কাল বিকালে বাহির হইয়াছিলাম । প্রথম ছবিটা দেখিয়াই মনে হইল, বোম্বাই শহরের একটা বিশেষ চেহারা আছে ; কলিকাতার যেন কোনো চেহারা নাই, সে যেন যেমন-তেমন করিয়া জোড়ােতাড়া দিয়া তৈরি হইয়াছে । আসল কথা, সমুদ্র বোম্বাই শহরকে আকার দিয়াছে, নিজের অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি বেলাভূমি দিয়া তাহাকে আঁকড়িয়া ধরিয়াছে। সমুদ্রের আকর্ষণ বোম্বাইয়ের সমস্ত রান্তা-গলির ভিতর দিয়া কাজ করিতেছে। আমার মনে হইতেছে, যেন সমুদ্রটা একটা প্ৰকাণ্ড হৃৎপিণ্ড, প্রাণধারাকে বোম্বাইয়ের শিরা-উপশিরার ভিতর দিয়া টানিয়া লইতেছে এবং ভরিয়া দিতেছে। সমূদ্র চিরদিন এই শহরটিকে বৃহৎ বাহিরের দিকে মুখ করিয়া রাখিয়া দিয়াছে। প্রকৃতির সঙ্গে কলিকাতার মিলনের একটি বন্ধন ছিল গঙ্গা। এই গঙ্গার ধারাই সুদূরের বার্তাকে সুদূর রহস্যের অভিমুখে বহিয়া লইয়া যাইবার খেলা পথ ছিল। শহরের এই একটি জানাল ছিল সেখানে মুখ বাড়াইলে বােঝা যাইত, জগৎটা এই লোকালয়ের মধ্যেই বন্ধ নহে। কিন্তু, গঙ্গার প্রাকৃতিক মহিমা আর রহিল না, তাহাকে দুই তীরে এমনি আঁটাির্সাটা পোশাক পরাইয়াছে, এবং তাহার কোমরবন্ধ এমন কবিয়া বাধিয়াছে যে, গঙ্গাও লোকালয়েরই পেয়াদার মূর্তি ধরিয়াছে, গাধাবোট বোঝাই করিয়া পাটের বস্তা চালান করা ছাড়া তাহার যে আর-কোনো বড়ো কাজ ছিল তাহা আর বুঝিবার জো নাই। জাহাজের মন্তলের কণ্টকারণ্যে মকরবাহিনীর মকরের শুড় কোথায় লজ্জায় লুকাইল ।”. সমুদ্রের বিশেষ মহিমা এই যে, মানুষের কাজ সে করিয়া দেয়। কিন্তু দাসত্বের চিহ্ন সে গলায় পরে না। পাটের কারবার তাহার বিশাল বক্ষের নীলকান্ত মণিটিকে ঢাকিয়া ফেলিতে পারে না। তাই এই শহরের ধারে সমুদ্রের মূর্তিটি অক্লান্ত ; যেমন এক দিকে সে মানুষের কাজকে পৃথিবীময় ছড়াইয়া দিতেছে তেমনি আর-এক দিকে সে মানুষের শ্ৰান্তি হরণ করিতেছে, ঘোরতর কর্মের সম্মুখেই বিরাট একটি অবকাশকে মেলিয়া রাখিয়াছে।