পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় VO অবজ্ঞা করেন ; পরিচ্ছন্নতা দ্বারা ইহারা নিজেকে বিশিষ্টতা দান করিয়াছে। এটুকু মানুষের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের কর্তব্য ; এইটুকু আবরণ, এইটুকু সজা প্রত্যেকের না থাকিলে মানুষের রিক্ততা অত্যন্ত কুগ্ৰী হইয়া দেখা দেয়। আপনার সমাজকে কুদৃশ্য দীনতা হইতে প্ৰত্যেকেই যদি রক্ষার চেষ্টা না করে তবে কত বড়ো একটা শৈথিল্যে সমস্ত দেশকে বিশ্বের চক্ষে অপমানিত করিয়া রাখে, তাহা অভ্যাসের অসাড়তা-বশতই আমরা বুঝিতে পারি না। আর-একটা জিনিস বোম্বাই শহরে অত্যন্ত বড়ো করিয়া চোখে পড়িল। সে এখানকার দেশী লোকের ধানশালিতা। কত পার্সি মুসলমান ও গুজরাটি বণিকদের নাম এখানকার বড়ো বড়ো বাড়ির গায়ে খোদা দেখিলাম। এত নাম কলিকাতার কোথাও দেখা যায় না। সেখানকার ধন চাকরিতে ও জমিদারিতে ; এইজন্য তাহা বড়ো স্নান। জমিদারির সম্পদ বন্ধ জলের মতো ; তাহা কেবলই ব্যবহারে ক্ষীণ ও বিলাসে দূষিত হইতে থাকে। তাহাতে মানুষের শক্তির প্রকাশ দেখি না ; তাহাতে ধনাগমের নব নব তরঙ্গলীলা নাই। এইজন্য আমাদের দেশে যেটুকু ধন সঞ্চয় আছে তাহার মধ্যে অত্যন্ত একটা ভীরুতা দেখি। মাড়োয়ারি পার্সি গুজরাটি পাঞ্জাবিদের মধ্যে দানে মুক্তহস্ততা দেখিতে পাই, কিন্তু বাংলাদেশ সকলের চেয়ে অল্প দান করে । আমাদের দেশের চাদার খাতা আমাদের দেশের গোরুর মতো- তাহার চরিবার স্থান নাই বলিলেই হয় । ধন জিনিসটাকে আমাদের দেশ সচেতনভাবে অনুভব করিতেই পারিল না, এইজন্য আমাদের দেশের কৃপণতাও কুশ্ৰী, বিলাসও বীভৎস । এখানকার ধনীদের জীবনযাত্রা সরল অথচ ধনের মূর্তি উদার, ইহা দেখিয়া আনন্দবোধ হয়। আষাঢ় ১৩১৯ জলস্থল আমরা ডাঙার মানুষ, কিন্তু আমাদের চারি দিকে সমুদ্র । জল এবং স্থল এই দুই বিরোধী শক্তির মাঝখানে মানুষ । কিন্তু, মানুষের প্রাণের মধ্যে এ কী সাহস । যে জলের কুল দেখিতে পাই না মানুষ তাহাকেও বাধা বলিয়া মানিল না, তাহার মধ্যে ভাসিয়া পড়িল । যে জল মানুষের বন্ধু সেই জল ডাঙার মাঝখান দিয়াই বহে । সেই নদীগুলি ডাঙার ভগিনীদের মতো। তাহারা কত দূরের পাথর-বাধা ঘাট হইতে কঁাখে করিয়া জল লইয়া আসে ; তাহারাই আমাদের তৃষ্ণা দূর করে, আমাদের অন্নের আয়োজন করিয়া দেয়। কিন্তু, আমাদের সঙ্গে সমুদ্রের এ কী বিষম বিরোধ। তাহার অগাধ জলরাশি সাহারার মরুভূমির মতোই পিপাসায় পরিপূর্ণ। আশ্চর্য, তবু সে মানুষকে নিরন্ত করিতে পারিল না। সে যমরাজের নীল মহিষটার মতো কেবলই শিঙ তুলিয়া মাথা বঁটাকাইতেছে, কিন্তু কিছুতেই মানুষকে পিছু হঠাইতে পারিল না। পৃথিবীর এই দুইটা ভাগ- একটা আশ্রয়, একটা অনাশ্রয় ; একটা স্থির, একটা চঞ্চল ; একটা শান্ত, একটা ভীষণ । পৃথিবীর যে সন্তান সাহস করিয়া এই উভয়কেই গ্রহণ করিতে পারিয়াছে সেই তো পৃথিবীর পূর্ণ সম্পদ লাভ করিয়াছে। বিদ্রের কাছে যে মাথা ঠোঁট করিয়াছে, ভয়ের কাছে যে পাশ কাটাইয়া চলিয়াছে, লক্ষ্মীকে সে পাইল না। এইজন্য আমাদের পুরাণকথায় আছে, চঞ্চলা লক্ষ্মী চঞ্চল সমুদ্র হইতে উঠিয়াছেন, তিনি আমাদের স্থির মাটিতে জন্মগ্রহণ করেন নাই । বীরকে তিনি আশ্রয় করবেন, লক্ষ্মীর এই পণ। এইজন্যই মানুষের সামনে তিনি প্ৰকাণ্ড এই ভয়ের তরঙ্গ বিস্তার করিয়াছেন। পার হইতে পারিলে তবে তিনি ধরা দিবেন। যাহারা কুলে বসিয়া কলশজে ঘুমাইয়া পড়িল, হাল ধরিল না, পাল মেলিল না, পাড়ি দিল না, তাহারা পৃথিবীর ঐশ্বৰ্য হইতে বঞ্চিত হইল ।